এখন করণীয় কী?
ছ’মাস পাখিটাকে পালতে হবে। গোটা শীতকালটা তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।
আমি তোমাকে আগেই বলেছি আমার পক্ষে সম্ভব না।
আমি টেলিফোন নামিয়ে রাখলাম এবং দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভাবলাম, কোন কুক্ষণে জানি এই পাখি ঘরে এনেছিলাম।
একদিন পর আবার পশুপাখি ক্লেশ নিবারণ সমিতির বড়-কর্তার টেলিফোন, আমেদ, তুমি নাকি তোমার পাখি নিতে রাজি হচ্ছ না?
এটা আমার পাখি না। বনের পাখি। খানিকক্ষণের জন্যে বাসায় নিয়ে গিয়েছিলাম।
পাখিটির এই দুঃসময়ে তুমি তার পাশে দাঁড়াবে না? এই মাইগ্রেটরি পাখি যাবে কোথায়?
আমি খাঁটি বাংলা ভাষায় বললাম, জাহান্নামে যাক।
তুমি কী বললে?
বললাম যে তোমরা একটা ব্যবস্থা কর। আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আমার মেয়ে পাখি পছন্দ করে না। আমি বরং এই ছ’মাস পাখিটিকে বাঁচিয়ে রাখতে যা খরচ হয় তা দিতে রাজি আছি।
ভদ্রলোক বললেন, দেখি কী করা যায়। বাকি দিনগুলি আতংকের মধ্যে কাটতে লাগলো। টেলিফোন বাজলেই চমকে উঠি, ভাবি এই বুঝি পশুপাখিওয়ালারা নতুন ঝামেলা করছে।
দিন দশেক পার হ’ল। আমি হাঁফ ছেড়ে ভাবলাম, যাক আপদ চুকেছে। তখন আবার টেলিফোন। সেই পশুপাখি ক্লেশ নিবারণ সমিতি। তবে এবার তাদের গলায় আনন্দ ঝরে পড়ছে।
আমেদ, সুসংবাদ আছে।
কী সুসংবাদ?
তোমার পাখির একটা গতি করা গেছে।
তাই নাকি? বাহ্ কী চমৎকার।
আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, সিয়াটল ওয়াশিংটনে এই পাখি এখনো আছে, সিয়াটলে শীত এখনো তেমন পড়েনি। কাজেই পাখিরা মাইগ্রেট করেনি।
বল কী?
আমরা তোমার পাখিটি সিয়াটল পাঠিয়ে দিচ্ছি। সিয়াটলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে, সে অন্য পাখিদের সঙ্গে মিশে মাইগ্রেট করবে।
অসাধারণ।
আগামী মঙ্গলবার পাখিটি সিয়াটল যাচ্ছে। তুমি বেলা তিনটায় গ্রে হাউন্ড বাস স্টেশনে চলে আসবে। শেষবারের মতো তোমার পাখিটাকে হ্যালো বলবে।
অবশ্যই বলব।
সিয়াটল ফার্গো থেকে তিন হাজার মাইল দূরে। পাখিটাকে খাঁচায় করে গ্রে হাউন্ড বাসের ড্রাইভারের হাতে তুলে দেয়া হলো। আমি হাত নেড়ে পাখিটাকে বাই জানালাম। মনে মনে বললাম, এই আমেরিকানরাই মাইলাই হত্যাকাণ্ড ঘটায়। বোম ফেলে হিরোশিমা নাগাশাকিত। কী করে তা সম্ভব হয় কে জানে।
ক্যাম্পে
আমার বরাবরই সন্দেহ ছিল আমেরিকানরা জাতি হিসাবে আধাপাগল। এদের রক্তে পাগলামি মিশে আছে। এমন সব কাণ্ডকারখানা করে যা বিদেশী হিসেবে বিস্মিত হওয়া ছাড়া আমাদের কিছু করার থাকে না। যেমন ওদের ক্যাম্পিং-এর ব্যাপারটা ধরা যাক। আগে ক্যাম্পিং বিষয়ে কিছুই জানতাম না। কেউ আমাকে কিছু বলেও নি নিজেই লক্ষ করলাম, সামারের ছুটিতে দলবল নিয়ে এরা কোথায় যায়। ফিরে আসে কাকতাড়ুয়া হয়ে, গায়ের চামড়া খসখসে, চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, চুল উস্কুথু। ওজনও অনেক কমে গেছে। সেই কারণেই হয়ত সবাইকে খানিকটা লম্বা দেখায়। কোথায় গিয়েছিলে জিজ্ঞেস করলে বলে, –ক্যাম্পে।
সেটা কি?
না।
ক্যাম্পিং কি তুমি জান না?
আমার ‘না’ শুনে তারা এমন একটি ভঙ্গি করে–যেন আমার মতো জংলি এ দেশে কেন এল তা তারা বুঝতে পারছে না।
খোঁজ নিয়ে জানলাম প্রতিটি আমেরিকান পরিবার বছরে খানিকটা জংগলে কাটায়। তবুটাবু নিয়ে কোনো-এক বিজন বনে চলে যায়। একে তারা বলে প্রকৃতির কাছাকাছি চলে যাওয়া।
ল্যাবরেটরিতে আমার সঙ্গে কাজ করে কোয়ান্ডাল। সে তার ছেলে বন্ধুকে নিয়ে ক্যাম্পিং-এ গেল। ফিরে এল হাতে এবং পায়ে গভীর ক্ষতচিহ্ন নিয়ে। গিজলি বিয়ার (প্রকাণ্ড ভালুক) নাকি তাদের ভঁৰু আক্রমণ করেছিল। ভয়াবহ ব্যাপার। অথচ রুথ কোয়ান্ডাল এমন ভাব করছে যেন জীবনে এরকম ফান হয়নি। আমি মনে মনে বললাম, বদ্ধ উন্মাদ।
উন্মাদ রোগ সম্ভবত ছোঁয়াচে, কারণ পরের বছর আমি নিজেও ক্যাম্পিং-এ যাব বলে ঠিক করে ফেললাম। দেখাই যাক ব্যাপারটা কি। আমার দ্বিতীয় মেয়েটির বয়স তখন তিন মাস। ফার্গো শহরে যে কটি বাঙালি পরিবার সে সময় ছিল সবাই আমাকে আটকাবার চেষ্টা করল। তাদের যুক্তি–এত বাচ্চা একটা মেয়ে নিয়ে এরকম পাগলামির কোনো মানে হয় না। মানুষের উপদেশ আমি খুব মন দিয়ে শুনি, তবে উপদেশ মতো কখনো কিছু করি না। কাজেই চল্লিশ ডলার দিয়ে ইউনিভারসিটি থেকে একটা ভাবু ভাড়া করলাম, একটা এলুমিনিয়ামের নৌকা ভাড়া করলাম, আর ভাড়া করলাম ক্যাম্পিং-এর জিনিসপত্র। সেই সব জিনিসপত্রের মধ্যে আছে কুড়াল, ফার্স্ট এইড বক্স, সাপে কাটার অষুধ এবং কী আশ্চর্য একটা হ্যারিকেন। খোদ আমেরিকাতেও যে কেরোসিনের হ্যারিকেন পাওয়া যায় কে জানত।
যথাসময়ে গাড়ির ছাদে নৌকা বেঁধে রওয়ানা হয়ে গেলাম। গায়ে ক্যাম্পিং এর পোশাক–হাফ প্যান্ট এবং বস্তার মতো মোটা কাপড়ের প্ল্যাপ দেয়া শার্ট, মাথায় ক্রিকেট আম্পায়ারদের টুপির মতো ধবধবে সাদা টুপি। গাড়ি চলছে ঝড়ের গতিতে। বনে যাবার এই হচ্ছে নিয়ম। স্পিডিং-এর জন্য পুলিশ অবশ্যই গাড়ি থামাবে, তবে যখন বুঝবে এই দল ক্যাম্পিং-এ যাচ্ছে তখন কিছু বলবে না। ক্যাম্পিং-এর প্রতি সবারই কিছুটা দুর্বলতা আছে।
ফার্গো শহর থেকে দুশ দশ কিলোমিটার দূরে এটা ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে গাড়ি থামালাম। সমস্ত আমেরিকা জুড়ে অসংখ্য ক্যাম্পিং গ্রাউন্ড আছে। ব্যক্তিমালিকানায় এইসব পরিচালিত হয়। টাকার বিনিময়ে ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে ঢোকা যায়। সেখানে ছোটখাটো একটা অফিস থাকে। বিজন জংলি জায়গা হলেও অফিসটা খুব আধুনিক হয়। টেলিফোনের ব্যবস্থা থাকে, ছোটখাটো বার থাকে, গ্রোসারি শপ এবং বেশ কিছু ভেন্ডিং মেশিন থাকে। সাধারণত স্বামী-স্ত্রী মিলে অফিস এবং দোকানপাট দেখাশোনা করেন।