সেই কিছুক্ষণ আমার কাছে অনন্তকাল বলে মনে হল। মনে হলো আমি লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আমার স্ত্রীর হাত ধরে প্রতীক্ষা করছি।
একসময় প্রতীক্ষার অবসান হ’লজন্ম হলো আমার দ্বিতীয় কন্যা শীলার। হাত পা ছুঁড়ে সে কাঁদছে, সরবে এই পৃথিবীতে তার অধিকার ঘোষণা করছে। যেন সে বলছে, এই পৃথিবী আমার, এই গ্রহ-নক্ষত্র-চন্দ্র-সূর্য আমার, এই অনন্ত নক্ষত্রবীথি আমার।
গুলতেকিন ক্লান্ত গলায় বলল, তুমি চুপ করে আছো কেন, আজান দাও। বাচ্চার কানে আল্লাহর নাম শোনাতে হয়।
আমি আমার ফুসফুসের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বললাম, আল্লাহু আকবর…
নার্সের হাতে একটা ট্রে ছিল। ভয় পেয়ে সে ট্রে ফেলে দিল। ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, What is happening?
তাদের কোনো কথাই আমার কানে ঢুকছে না। আমি অবাক হয়ে দেখছি আমার শিশু কন্যাকে। সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। পৃথিবীর রূপরসগন্ধ হয়তো-বা ইতিমধ্যেই তাকে অভিভূত করে ফেলেছে। আমি প্রার্থনা করলাম, যেন পৃথিবী তার মঙ্গলময় হাত প্রসারিত করে আমার কন্যার দিকে। দুঃখ-বেদনার সঙ্গে সঙ্গে যেন প্রগাঢ় আনন্দ বারবার আন্দোলিত করে আমার মা-মণিকে।
পাখি
উইন্টার কোয়াটার শুরু হয়েছে। শীত এখনো তেমন পড়েনি। ওয়েদার ফোরকাস্ট হচ্ছে দু’একদিনের মধ্যে প্রথম তুষারপাত হবে। এ বছর অন্য সব বছরের চেয়ে প্রচণ্ড শীত পড়বে, এরকম কথাবার্তাও শোনা যাচ্ছে। প্রাচীন মানুষেরা আকাশের রঙ দেখে শীতের খবর বলতে পারতেন। স্যাটেলাইটের যুগেও তাদের কথা কেমন করে জানি মিলে যায়।
ভোরবেলা ক্লাসে রওনা হয়েছি। ঘর থেকে বের হয়ে মনে হলো আজ ঠাণ্ডাটা অনেক বেশি। বাতাসের প্রথম ঝাপটায় মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। আমি ফিরে এসে পার্কা গায়ে দিয়ে রওনা হলাম। পার্কা হচ্ছে এমন এক শীতবস্ত্র যা পরে শূন্যের ত্রিশ ডিগ্রি নিচেও দিব্যি ঘোরাফেরা করা যায়।
হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি, হঠাৎ দেখি পায়ের সামনে চড়ুই পাখির মতো কালো রঙয়ের একটা পাখি ‘চিকু চিকু’ ধরনের শব্দ করছে। মনে হলো শীতে আড়ষ্ট হয়ে গেছে। আমি পাখিটিকে হাতে উঠিয়ে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সে আমার আঙুলে ঠোঁট ঘষতে লাগলো। আমার মনে হলো পাখিদের কায়দায় সে বলল তোমাকে ধন্যবাদ। আমি তাকে নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। উদ্দেশ্য, আমার কন্যাকে পাখিটা দেব। সে জীবন্ত খেলনা পেয়ে উল্লসিত হবে। শিশুদের উল্লাস দেখতে বড় ভালো লাগে।
আমার কন্যা পাখি দেখে মোটেই উল্লসিত হলো না। ভয় পেয়ে চেঁচাতে লাগলো। মুগ্ধ হলো মেয়ের মা। সে বারবার বলতে লাগল–ও মা কী সুন্দর পাখি। ঠোঁটগুলো দেখ, মনে হচ্ছে চব্বিশ ক্যারেট গোল্ডের তৈরি। সে পাখিকে পানি খেতে দিল, ময়দা গুলে দিল। পাখি কিছুই স্পর্শ করল না। একটু পরপর বলতে লাগল ‘চিকু চিকু। ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছিল, আমি ক্লাসে চলে গেলাম। পাখির কথা আর মনে রইল না।
বিকেল তিনটার দিকে আমার কাছে একটা টেলিফোন এল। এক আমেরিকান তরুণী খুবই পলিশড গলায় বলল, মি, আমেদ, তুমি কি কোনো পাখি কুড়িয়ে পেয়েছ?
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, হ্যাঁ, কিন্তু তুমি এই খবর জানলে কোত্থেকে?
আমার বস আমাকে বললেন, আমি ফারগো পশু-পাখি ক্লেশ নিবারণ সমিতির অফিস থেকে বলছি।
আমি আতংকিত গলায় বললাম, পাখিকে বাসায় নিয়ে যাওয়া কি বেআইনি
না, বেআইনি নয়। আমরা তোমার পাখিকে পরীক্ষা করতে চাই। মনে হচ্ছে ওর ডানা ভেঙে গেছে।
আমি কি পাখিকে নিয়ে আসবো?
তোমাকে আসতে হবে না, আমাদের লোক গিয়ে নিয়ে আসবে। তোমার অ্যাপার্টমেন্টের নাম্বার বল।
আমি নাম্বার বললাম। এবং মনে মনে ভাবলাম, এ-কী যন্ত্রণার পড়া গেল। বাসায় এসে দেখি পাখিটির জন্য আমার স্ত্রী কার্ডবোর্ডের একটা বাসা বানিয়েছে। নানান খাদ্যদ্রব্য তাকে দেওয়া হচ্ছে। সে কিছু কিছু খাচ্ছে। তবে আমার কন্যার ভয় ভাঙেনি। সে মার কোল থেকে নামছে না। পাখির কাছে নিয়ে গেলেই চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করছে।
আমার স্ত্রীর কাছে শুনলাম পাশের অ্যাপার্টমেন্টের এক মহিলা এসেছিলেন বেড়াতে, পাখি দেখে তিনিই টেলিফোন করেন।
পশু-পাখি ক্লেশ নিবারণ সমিতির লোক এসে সন্ধ্যার আগে পাখি নিয়ে গেল। রাত আটটায় টেলিফোন করে জানালো যে পাখিটার ডানা ভাঙা। এক্সরেতে ধরা পড়েছে। তাকে পৃগু হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে ডানা জোড়া লাগানো যায়। যদিও এসব ক্ষেত্রে চেষ্টা সাধারণত ফলপ্রসূ হয় না।
আমি মনে মনে ভাবলাম, এ তো দেখি ভালো যন্ত্রণা হ’ল। মুখে বললাম, আমি খুবই আনন্দিত যে পাখিটার একটা গতি হচ্ছে। পাখি নিয়ে খুবই দুশ্চিন্তায় ছিলাম।
সাতদিন কেটে গেল। পাখির কথা প্রায় ভুলতে বসেছি, তখন টেলিফোন এল হাসপাতাল থেকে। ডাক্তার সাহেব আনন্দিত গলায় বললেন, ডানা জোড়া লেগেছে।
আমি বললাম, ধন্যবাদ। আমি অত্যন্ত আনন্দিত।
পাখিটি তোমার কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি।
তার কোনো প্রয়োজন দেখছি না। আমার মেয়ে এই পাখি ঠিক পছন্দ করছে না। সে উলের কাঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে পাখিটাকে মেরে ফেলতে পারে বলে আমার ধারণা।
তাহলে তো বিরাট সমস্যা হল।
কী সমস্যা?
দেখ, এটা হচ্ছে মাইগ্রেটরি বার্ড। শীতের সময়ে গরমের দেশে উড়ে চলে যায়। সমস্যাটা হলো ফারগোতে শীত পড়ে গেছে। এই গোত্রের পাখি সব উড়ে চলে গেছে। একমাত্র তোমার পাখিটিই যেতে পারেনি।