সন্ধ্যাবেলা প্রফেসরের সেই কাজ শেষ হ’ল। তিনি তার সমস্ত ছাত্রদের ডেকে গম্ভীর গলায় বললেন, আমার ছাত্র আহামাদ নাভাদার লাস ভেগাসে তার আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করবে। সে একটা পেপার দেবে। পেপারের খসড়া আমি তৈরি করে ফেলেছি।
আমার মাথা ঘুরে গেল। ব্যাটা বলে কী? পৃথিবীর সব বড় বড় রসায়নবিদরা জড়ো হবে সেখানে। এইসব জ্ঞানী-গুণীদের মধ্যে আমি কেন? এক অক্ষর ইংরেজী আমার মুখ দিয়ে বের হয় না। যা বের হয় তার অর্থ কেউ বুঝে না। আমি এ-কী বিপদে পড়লাম।
প্রফেসর বললেন, আহামাদ, তোমার মুখ এমন শুকনো দেখাচ্ছে কেন?
আমি কাষ্ঠ হাসি হেসে বললাম, আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
কেন জানতে পারি?
আমি বক্তৃতা দিতে পারি না।
এটা খুবই সত্যি কথা।
আমি ইংরেজি বললে কেউ তা বুঝতে পারে না।
কারেক্ট। আমি এত দিন তোমার সঙ্গে আছি, আমি নিজেই বুঝি না। অন্যরা কী বুঝবে।
আমি খুবই নার্ভাস ধরনের ছেলে। কী বলতে কী বলব।
দেখ আহমাদ, আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির অধিবেশনে কথা বলতে পারার সৌভাগ্য সবার হয় না। তোমার হচ্ছে।
এই সৌভাগ্য আমার চাই না।
বাজে কথা বলবে না। কাজটা তুমি করেছ। আমি চাই সম্মানের বড় অংশ তুমি পাও। কেন ভয় পাচ্ছ। আমি তোমার পাশেই থাকব।
আমি মনে মনে বললাম–ব্যাটা তুই আমাকে এ-কী বিপদে ফেললি।
পনেরো দিনের মধ্যে চিন্তায় চিন্তায় আমার দুপাউণ্ড ওজন কমে গেল। আমার দুশ্চিন্তার মূল কারণ হচ্ছে কাজটা আধখেচড়াভাবে হয়েছে। কেউ যদি কাজের উপর জটিল কোনো প্রশ্ন করে বসে জবাব দিতে পারব না। এ রকম অপ্রস্তুত অবস্থায় এত বড় বিজ্ঞান অধিবেশনে যাওয়া যায় না। বাটা প্রফেসর তা বুঝবে না।
প্রফেসর তার গাড়িতে করে আমাকে লাস ভেগাসে নিয়ে গেলেন। মরুভূমির ভেতর আলো ঝলমল একটি শহর। জুয়ার তীর্থভূমি। নাইট ক্লাব এবং ক্যাসিনোতে ভরা। দিনের বেলা এই শহর ঝিম মেরে তাকে। সন্ধ্যার পর জেগে ওঠে। সেই জেগে ওঠাটা ভয়াবহ।
আমার প্রফেসরেরও এই প্রথম লাস ভেগাসে আগমন। তিনিও আমার মতোই ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছেন। হা হয়ে দেখছেন রাস্তার অপূর্ব সুন্দরীদের ভীড়। প্রফেসর আমার কানে কানে বললেন, এই একটি জায়গাতেই প্রসটিডিউশন নিষিদ্ধ নয়। যাদের দেখছ, তাদের প্রায় সবাই এ জিনিস। দেখবে পৃথিবীর সব সুন্দরী মেয়েরা এসে টাকার লোভে এখানে জড় হয়েছে।
কিছুদূর এগুতেই এক সুন্দরী এগিয়ে এসে বলল, সান্ধ্যকালীন কোনো বান্ধবীর কি প্রয়োজন আছে?
আমি কিছু বলবার আগেই প্রফেসর বললেন, না ওর কোনো বান্ধবীর প্রয়োজন নেই।
মেয়েটি নীল চোখ তুলে শান্ত গলায় বললেন, তোমাকে তো জিগগেস করিনি। তুমি কথা বলছ কেন?
আমি বললাম, তোমায় ধন্যবাদ, আমার বান্ধবীর প্রয়োজন নেই।
মেয়েটি বলল, সুন্দর সন্ধ্যাটা একা একা কাটাবে। এক গ্লাস বিয়ারের বদলে আমি তোমার পাশে বসতে পারি।
আমরা কথা না বলে এগিয়ে গেলাম। পথে আরো দুটি মেয়ের সঙ্গে কথা হ’ল। এদের একজন মধুর ভঙ্গিতে বলল, তোমাদের কি ডেট লাগবে? লাগলে লজ্জা করবে না।
আমার প্রফেসর মুখ গম্ভীর করে আমাকে বুঝালেন,–এরা ভয়াবহ ধরনের প্রস্টিটিউট। তোমার কাছ থেকে টাকা-পয়সা নেবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত গায়ে হাত পর্যন্ত দিতে দেবে না। পত্রপত্রিকায় এদের সম্পর্কে অনেক লেখালেখি হয়েছে।
প্রফেসরের ভাব এরকম যে গায়ে হাত দিতে দিলে তিনি রাজি হয়ে যেতেন।
রাতের খাবার খেতে আমরা যে রেস্টুরেন্টে গেলাম তা হচ্ছে টপলেস রেস্টুরেন্ট। অর্থাৎ ওয়েট্টেসদের বুকে কোনো কাপড় থাকবে না। বইপত্রে এইসব রেস্টুরেন্টের কথা পড়েছি। রাস্তায় এই প্রথম দেখলাম। আমার লজ্জায় প্রায় মাথা কাটা যাবার মতো অবস্থা। মেয়েগুলিকে মনে হলো আড়ষ্ট ও প্রাণহীন। এদের মুখের দিকে কেউ তাকাচ্ছে না, সবাই তাকাচ্ছে বুকের দিকে। কাজেই তারা খানিকটা প্রাণহীন হবেই। চোখের একটা নিজস্ব ভাষা আছে। চোখের উপর চোখ রেখে আমরা সেই ভাষায় কথা বলি। এই সব মেয়ে চোখের ভাষা কখনো ব্যবহার করতে পারে না। এরা বড় দুঃখী।
প্রফেসর বিরক্ত মুখে আমাকে বললেন, আমাদের এই টেবিলে বসাটাই ভুল হয়েছে। এই টেবিলের ওয়েট্রেসদের বুকের দিকে তাকিয়ে দেখ। ছেলেদের বুক এরচে অনেক ডেভেলপড় হয়। এর বুক দেখে মনে হচ্ছে প্রেইরির সমতলভূমি।
রাতের খাবারের পর আমরা একটা শো দেখলাম। প্রায় নগ্ন কিছু নারীপুরুষ মিলে গান বাজনা নাচ করল। একটি জাপানি মেয়ে সারা শরীর পালকে ঢেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দর্শকদের কাছে আসছে দর্শকরা একটা করে পালক তুলে নিচ্ছে। তার গা ক্রমশ খালি হয়ে আসছে। সর্বশেষ পালকটি তার গা থেকে খুলে নেবার পর সে স্টেজে চলে গেল এবং চমত্তার একটি নাচ দেখাল। যে মেয়ে এত সুন্দর নাচ জানে তার খালি গা হবার প্রয়োজন পড়ে না।
রাত বারটায় শো শেষ হবার পর আমার প্রফেসর বললেন, লাস ভেগাসে রাত শুরু হয় বারোটার পর। এখন হোটলে গিয়ে ঘুমুবার কোনো মানে হয় না।
আমি বললাম, তুমি কি করতে চাও?
জুয়া খেলবে নাকি?
জুয়া কী করে খেলতে হয়, আমি জানি না।
আমিও জানি না। তবে স্লট মেশিন জিনিসটা বেশ মজার। নিকেল, ডাইম কিংবা কোয়ার্টার (বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা) মেশিনের ফোকরে ফেলে একটা হাতল ধরে টানতে হয়। ভাগ্য ভালো হলে কম্বিনেশন মিলে যায়, ঝুনঝুন শব্দে প্রচুর মুদ্রা বেরিয়ে আসে।