দ্বিতীয় দিন পার হ’ল। রাত এল। আমি ঠিক করলাম রাতের মধ্যে যদি কোনো খোঁজ না পাই তাহলে দেশে খবর দেব।
রাত আটটায় একটা টেলিফোন এল। একজন মহিলা এ্যাটোনি আমাকে জানালেন যে আমার স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদ আমার ব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়েছেন। তিনি ডিভোর্সের মামলা করতে চান।
আমি বললাম, খুবই উত্তম কথা। সে আছে কোথায়?
সে তার এক বান্ধবীর বাড়িতে আছে। সেই ঠিকানা তোমাকে দেয়া যাবে না। আমি কি মামলার বিষয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলব?
মামলার বিষয়ে কথা বলার কিছুই নেই। আমাদের বিয়ের নিয়ম-কানুন খুব সহজ। এই নিয়মে আমার স্ত্রীকে স্বামী পরিত্যাগ করার অধিকার দেয়া আছে। এই অধিকার বলে সে যে কোনো মুহূর্তে আমাকে ত্যাগ করতে পারে। তার জন্যে কোর্টে যাবার প্রয়োজন নেই।
তোমাদের দেশের নিয়ম-কানুন তোমাদের দেশের জন্যে। আমেরিকায় এই নিয়ম চলবে না।
তোমার বকবকানি শুনতে আমার মোটেই ভালো লাগছে না। তুমি কি দয়া করে আমার স্ত্রীর সঙ্গে আমার যোগাযোগ করিয়ে দেবে?
আমি তোমার অনুরোধের কথা তাকে বলতে পারি। যোগাযোগ করবার দায়িত্ব তার।
বেশ তাই কর।
আমি টেলিফোন নামিয়ে সারা রাত জেগে রইলাম-যদি গুলতেকিন টেলিফোন করে। সে টেলিফোন করল না। বিভীষিকাময় একটা রাত কাটল। ভোরবেলা সে এসে হাজির।
যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে সে রান্নাঘরে ঢুকে চায়ের কেতলি বসিয়ে দিল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। কিছুই বলছি না। সে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দু’কাপ চা বানিয়ে এক কাপ আমার সামনে রেখে বলল, তোমাকে আমি একটা শিক্ষা দিলাম। যাতে ভবিষ্যতে আমার সঙ্গে আর খারাপ ব্যবহার না কর। যদি কর আমি কিন্তু ফিরে আসব না।
আমি বললাম, আমেরিকা তোমাকে বদলে দিয়েছে।
হ্যাঁ দিয়েছে। এই বদলানোটা কি খারাপ?
নী।
না-বলার সৎ সাহস যে তোমার হয়েছে সে জন্যে তোমাকে ধন্যবাদ। তবে যে বিদ্রোহ এখানে আমি করতে পারলাম দেশে থাকলে তা কখনো করতে পারতাম না। দিনের পর দিন অপমান সহ্য করে পশু-শ্রেণীর স্বামীর পায়ের কাছে পড়ে থাকতে হত।
আমি কি পশু-শ্রেণীর কেউ?
হ্যাঁ। নাও চা খাও। তোমার চেহারা এত খারাপ হয়েছে কেন? এই দুদিন কিছুই খাওনি বোধ হয়?
বলতে বলতে পশু-শ্রেণীর একজন মানুষের প্রতি গাঢ় মমতায় তার চোখে জল এসে গেল।
সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমি জানি এর পরেও তুমি আমার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করবে, তবুও আমি বারবার তোমার কাছেই ফিরে আসব। এই দুদিন আমি একবারও আমার মেয়ের কথা ভাবিনি। শুধু তোমার কথাই ভেবেছি।
আমি মনে মনে বললাম, ভালোবেসে যদি সুখ নাহি তবে কেন মিছে এ ভালোবাসা। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ জনেছিলেন। না জন্মালে ভাব প্রকাশে আমাদের বড় অসুবিধা হত।
ম্যারাথন কিস
চুমু প্রসঙ্গে আরেকটি গল্প বলি। গল্পের নায়ক আমার ছাত্র–বেন ওয়ালি। টিচিং অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে আমি এদের প্রবলেম ক্লাস নেই। সপ্তাহে একদিন এক ঘণ্টা থার্মোডিনারিক্সের অংক করাই এবং ছাত্রদের প্রশ্নের জবাব দেই।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, আন্ডার-গ্রাজুয়েটে যে সব আমেরিকান পড়তে আসে, তাদের প্রায় সবাই গাধা টাইপের। কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে হা করে তাকিয়ে থাকে। প্রবল বেগে মাথা চুলকায়। অংক করতে দিলে শুকনো গলায় বলে, আমার ক্যালকুলেটরে ব্যাটারি ডাউন হয়ে গেছে।
আন্ডার-গ্রাজুয়েট পড়াশোনা এদের তেমন জরুরি নয়। খেয়ে পরে বেঁচে থাকার জন্য হাইস্কুলের শিক্ষাই যথেষ্ট। এদের কাছে ইউনিভার্সিটির ফুটবল টিম, বেসবল টিম পড়াশোনার চেয়ে অনেক জরুরি। মেয়েদের লক্ষ থাকে ভালো একজন স্বামী জোগাড় করার দিকে। এই কাজটি তাদের নিজেদেরই করতে হয় এবং এর জন্যে যে পরিমাণ কস্ট এক একজন করে তা দেখলে চোখে পানি এসে যায়।
আমার সঙ্গে রুখ কোয়ান্ডাল বলে এক আমেরিকান ছাত্রী পি-এইচ-ডি করত। এই মেয়েটি কোনো স্বামী জোগাড় করতে পারেনি। ভবিষ্যতেও যে পারবে এমন সম্ভাবনাও নেই। মেয়েটি মৈনাক পর্বতের মত। সে আমকে দুঃখ করে বলেছিল, আমার যখন সতেরো-আঠারো বছর বয়স ছিল তখন আমি এত মোটা ছিলাম না। চেহারাও ভালোই ছিল। তখন থেকে চেষ্টা করছি একজন ভালো ছেলে জোগাড় করতে পারিনি। কত জনের সঙ্গে যে মিশেছি। ওদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে রাখার জন্যে কত কিছু করতে হয়েছে। আগেকার অবস্থা তো নেই, এখন ছেলেরা ডেটিং-এর প্রথম রাতেই বিছানায় নিয়ে যেতে চায়। না করি না। না করলে যদি বিরক্ত হয়। আমাকে ছেড়ে অন্য কোনো মেয়ের কাছে চলে যায়। এত কিছু করেও ছেলে জুটাতে পারলাম না।
কেন পারলে না।
পারলাম না, কারণ আমি অতিরিক্ত স্মার্ট। সারা জীবন ‘A’ পেয়ে এসেছি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্রীদের একজন। ছেলেরা এ রকম স্মার্ট মেয়ে পছন্দ করে না। তারা চায় পুতুপুতু ধরনে ভ্যাদা টাইপের মেয়ে। তুমি বিদেশী, আমাদের জটিল সমস্যা বুঝতে পারবে না।
আমি আসলেই বুঝতে পারি না। আমার মনে হয় এদের কোথায় যেন কী একটা হয়েছে। সবার মাথার ব্লু-র একটা পা কেটে গেছে। উদাহরণ দেই। এটি আমার নিজের চোখে দেখা।
পুরোদমে ক্লাস হচ্ছে। দেখা গেল ক্লাস থেকে দুটি ছেলে এবং একটি মেয়ে বের হয়ে গেল। সবার চোখের সামনে এর সমস্ত কাপড় খুলে ফেলল! এই ভাবেই সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় একটা চক্কর দিয়ে ফেলল। এর নাম হচ্ছে স্ট্রিকিং। এরকম করল কেন? এরকম করল কারণ এরা পৃথিবী জুড়ে যে আণবিক বোমা তৈরি হচ্ছে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাল।