.
পুনশ্চ
বৈরাগ্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
কহিল গভীর রাত্রে সংসারে বিরাগী
“গৃহ তেয়াগিব আজি ইষ্টদেব লাগি।
কে আমারে ভুলাইয়া রেখেছে এখানে?”
দেবতা কহিলা, “আমি।”–শুনিল না কানে।
সুপ্তিমগ্ন শিশুটিরে আঁকড়িয়া বুকে
প্রেয়সী শয্যার প্রান্তে ঘুমাইছে সুখে।
কহিল, “কে তোরা ওরে মায়ার ছলনা?”
দেবতা কহিলা, “আমি।”–কেহ শুনিল না।
ডাকিল শয়ন ছাড়ি, “তুমি কোথা প্রভু?”
দেবতা কহিলা, “হেথা।”–শুনিল না তবু।
স্বপনে কাঁদিল শিশু জননীরে টানি–
দেবতা কহিল, “ফির।” শুনিল না বাণী।
দেবতা নিশ্বাস ছাড়ি কহিলেন, “হায়!
আমারে ছাড়িয়া ভক্ত চলিল কোথায়?”
সরাসরি গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আছে, নাম ‘ব্রাহ্মণ’। এখানে সত্যকাম গিয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধের কাছে দীক্ষা নেওয়ার জন্যে। গৌতম তাকে ফিরিয়ে দেন। সত্যকাম মা’কে বলেন,
কহো গো জননী, মোর পিতার কী নাম,
কী বংশে জনম। গিয়াছিনু দীক্ষাতরে
গৌতমের কাছে, গুরু কহিলেন মোরে–
বৎস, শুধু ব্রাহ্মণের আছে অধিকার
ব্রহ্মবিদ্যা লাভে। মাতঃ কী গোত্র আমার?
শুনি কথা, মৃদুকণ্ঠে অবনত মুখে
কহিলা জননী, যৌবনে দারিদ্রদুখে
বহু পরিচর্যা করি পেয়েছিনু তোরে;
জন্মেছিস ভর্তৃহীনা জবালার ক্রোড়ে,
গোত্র তব নাহি জানি তাত।’
কৌতূহলী পাঠক পুরো কবিতাটি পড়তে পারেন।
রবীন্দ্রনাথ গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে কিছু প্রবন্ধও লিখেছেন। তিনি এই ধর্ম প্রচারককে শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ মানুষ বলে বিবেচনা করেছেন।
কিং সোলায়মান
০৪.
কিং সোলায়মান এবং শেবার রানীর গল্প তো সবাই জানেন। আরেকবার বলি। জানা বিষয় নতুন করে জানায় আনন্দ আছে। অনেকটা শোনা গান আবার শোনার মতো।
কিং সোলায়মান সিংহাসনে বসে আছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন শেবার রানী বিলকিস।
রানী রাজদরবারে ঢুকলেন। সোলায়মানের সিংহাসন অনেকটা দূরে। রানীকে কিছুদূর হেঁটে যেতে হবে। রানী ক্ষণিকের জন্যে বিভ্রান্ত হলেন। মেঝে স্ফটিক দিয়ে এমন করে বানানো যে রানীর মনে হলো পানি। তাকে যেতে হবে পানির উপর দিয়ে। নিজের অজান্তেই তিনি তাঁর গায়ের কাপড় খানিকটা উঁচুতে তুললেন, যাতে পানি লেগে ভিজে না যায়।
সিংহাসন থেকে সোলায়মান অবাক হয়ে দেখলেন, এই পৃথিবীর অতি রূপবতী এক তরুণীর পাভর্তি পশুদের মতো লোম। সোলায়মান রাজবৈদ্যকে এই রোগের ওষুধ দিতে বললেন। রাজবৈদ্যের ওষুধে রানীর লোম সমস্যা দূর হলো। কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ হয়ে তিনি সোলায়মানকে বিয়ে করলেন। (মিথ হচ্ছে– সোলায়মান তাঁর পোষা জ্বিনদের কাছ থেকে রানী বিলকিসের ওষুধ নিয়েছিলেন।)
সোলায়মান নবপরিণীতা স্ত্রীকে খুশি করার ব্যবস্থা করলেন। দুটা জাহাজ পাঠালেন রত্নের দেশে। দেশের নাম শ্রীলংকা।
শ্রীলংকাকে বলা হয় পৃথিবীর রত্নভাণ্ডার। ব্লু শেফায়ার বা নীলার মতো দামি পাথরে এই দেশ পূর্ণ। সবচেয়ে বেশি রত্ন যেখানে পাওয়া যায় তার নাম রত্নপুরা বা রত্নের নগর। চীনা ভাষায় দ্বীপটির নাম রত্নদ্বীপ। Star of India নাম দিয়ে যে অপূর্ব নীলা পাথরটি নিউইয়র্কের মিউজিয়াম অব ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে প্রদর্শিত হচ্ছে সেটা নীলা পাথর। পাথরটির নাম রাখা উচিত ছিল Star of Srilanka, ব্রিটিশ রাজমুকুটে চার শ ক্যারেটের যে নীলা পাথরটি আছে সেটাও শ্রীলংকার।
পদ্মরাগ মণি (নীলা পাথরের আরেক সংস্করণ। রঙ কমলা ও গোলাপির মিশ্রণ) শুধুমাত্র শ্রীলংকাতেই পাওয়া যায়। অন্য কোথাও না।
নীলা ছাড়াও আরও যেসব পাথর শ্রীলংকায় পাওয়া যায় তা হলো রুবি, একুয়া মেরিন, টোপাজ, গার্নেট, মুনস্টোন এমেথিস্ট, ক্যাটস আই।
মুর পর্যটক ইবনে বতুতা শ্রীলংকায় এসেছিলেন। তিনি তার ভ্রমণবৃত্তান্তে মুরগির ডিমের চেয়েও বড় রুবি দিয়ে হাতির মাথা সাজানো হতো বলে উল্লেখ করেছেন।
চায়নিজ পর্যটক ফা হিয়েন শ্রীলংকায় একটি রুবি দেখেছিলেন, যা মানুষের বাহুর মতো লম্বা এবং এক বিঘৎ চওড়া। রুবিটি দেখে তার মনে হয়েছে যেন পাথরটিতে আগুন জ্বলছে।
মার্কোপলোও মনে হয় এই রুবিটির প্রতি ইঙ্গিত করেছেন।
রত্ন আহরণের পদ্ধতি অত্যন্ত সহজ। নদীর কাদাবালি মেশানো পানি এবং নদীর তলদেশের মাটি ঝুড়িতে নেওয়া হয়। ঝুড়ির নিচটা চালনির মতো। এই ঝুড়ি পানিতে ধুয়ে ধুয়ে কাদামাটি এবং ময়লা দূর করা হয়। ভাগ্য ভালো হলে রত্ন পাওয়া যায়।
আমি মনে করি, বাংলাদেশের শংখ নদীতে এইভাবে রত্নের অনুসন্ধান করা যেতে পারে। শংখ নদী পাহাড়-পর্বত কেটে সমুদ্রের দিকে আছে। পাহাড়-পর্বতে আটকে থাকা মণিমুক্তা শংখ নদী বেয়ে নিচে নামার কথা।
আমাদের পাশের দেশ বার্মা যদি রুবিতে ভর্তি থাকে, আমরা দোষ করেছি কী? বার্মার মাটি, শ্রীলংকার মাটি আমাদের দেশের মতোই পলিঘটিত। পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়গুলো শ্রীলংকার চেয়ে উঁচু। বাংলাদেশে যে রত্নের অনুসন্ধান করা যেতে পারে তা মনে হয় কারও মাথায় আসে নি।
.
শ্রীলংকার মণিমুক্তা সম্পর্কে বিতং করে লেখার একটি ব্যক্তিগত কারণ আছে। আমার একসময়ের শখ ছিল রত্ন সংগ্রহ করা। পৃথিবীর যেখানেই গিয়েছি রত্ন কেনার চেষ্টা করেছি। কখনো পেরেছি, কখনো অর্থের অভাবে পারি নি। আমার সংগ্রহের রক্তে শ্রীলংকার দুর্লভ পদ্মরাগ মণি আছে।