বুদ্ধ বললেন, ঈশ্বর নেই এমন কথা কি আমি বলেছি?
ভক্ত মহা আনন্দিত। কারণ সে মনেপ্রাণে একজন ঈশ্বর চাইছে। ভক্ত বলল, গুরুজি, তাহলে কি ঈশ্বর আছে?
বুদ্ধ বললেন, ঈশ্বর আছেন এমন কথা কি আমি বলেছি?
গৌতম বুদ্ধের নিজের মধ্যে সংশয় ছিল–এমন কথা কি বলা যায়? তিনি ঈশ্বরের কথা বলেন নি, নির্বাণের কথা বলেছেন। কিন্তু নির্বাণ আসলে কী তা কখনো পরিষ্কার করে বলেন নি। একবার বললেন, জ্বলন্ত শিখাকে ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দেওয়াই নির্বাণ। তার কথা হলো, মানুষকে চারটি বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতেই হবে।
শোক
ব্যাধি
জরা
মৃত্যু
মানুষ বারবার পৃথিবীতে জন্মাবে (জন্মান্তরবাদ)। কীটপতঙ্গ হিসেবে, পশু হিসেবে, মানুষ হিসেবে। তার সুকীর্তির কারণে একটা সময় আসবে যখন আর তাকে পৃথিবীতে ফিরে আসতে হবে না। এটাই নির্বাণ।
আমার কাছে বারবার পৃথিবীতে ফিরে এসে শোক, ব্যাধি, জরা মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ অনেক আকর্ষণীয় মনে হয়। শোকের সঙ্গে থাকবে আনন্দ, জোছনাপ্লাবিত রজনী, প্রিয় সখার কোমল করস্পর্শ। যে নির্বাণ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় সেই নির্বাণ আমার কাছে গ্রহণযোগ্য না। আমি গৌতম বুদ্ধের যুক্তিই তাঁকে ফিরিয়ে দিচ্ছি। গৌতম বুদ্ধ বলেছেন, ‘যে ঈশ্বর ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তার বিষয়ে কি বলা যাবে?’
কমিউনিস্টদের আধুনিক কমিউনের শুরুটা গৌতম বুদ্ধ করে গেছেন। তাঁর কমিউনের নাম সংঘ (সংঘং শরণং গচ্ছামি)। সেখানে সবার খাবার একত্রে রান্না করা হতো। সংঘে নারীদের প্রবেশাধিকার ছিল না। ভিক্ষুরা ভোরবেলা শূন্য থালা হাতে বের হতেন। সারা দিন ভিক্ষা করে যা পাওয়া যেত তা-ই রান্না হতো। সবাই মিলে তা-ই খেতেন। সংঘে নারীদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ।
গৌতম বুদ্ধের খালা প্রজাপতি গৌতমী ছিলেন এক অর্থে গৌতম বুদ্ধের মা। তিনিই গৌতম বুদ্ধকে লালনপালন করেছিলেন। এই মহিলা বহু কষ্টে, পায়ে হেঁটে বহু পথ অতিক্রম করে তাঁর পালকপুত্রের কাছে এলেন। সংঘে যোগ দিবেন। বাকি জীবন সংঘে কাটাবেন।
গৌতম বুদ্ধ বললেন, না। সংঘে নারী নিষিদ্ধ।
একবার না, পরপর তিনবার তিনি এই বাক্য উচ্চারণ করলেন।
কাঁদতে কাঁদতে ফিরে গেলেন প্রজাপতি। গৌতম বুদ্ধের সার্বক্ষণিক সঙ্গী আনন্দ তখন বুদ্ধের কাছে কাতর আবেদন করলেন। তিনি যুক্তি দিলেন নারীরাও তো আলোকপ্রাপ্তির সুযোগ পেতে পারে। নারীদের বাদ দেওয়া মানে মানবজাতির অর্ধেককে বাদ দেওয়া।
গৌতম বুদ্ধ অনিচ্ছার সঙ্গে রাজি হলেন। তবে শর্ত জুড়ে দিলেন।
শর্ত হচ্ছে, নারীভিক্ষুরা যত উচ্চবর্ণের হোক তাদের পদমর্যাদা হবে সব পুরুষ ভিক্ষুর নিচে। যখনই নারীর সামনে কোনো পুরুষ ভিক্ষু দাঁড়াবে তখনই ভিক্ষুনীকে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখাতে হবে।
আনন্দ একবার জানতে চাইলেন, নারীদের প্রতি তাহলে আমরা কী আচরণ করব?
বুদ্ধ বললেন, তুমি তাদের দিকে ফিরেও তাকাবে না। তাহলেই কী আচরণ করবে সেই প্রশ্ন উঠবে না।
গৌতম বুদ্ধ নারীদের সাধনার বিঘ্ন মনে করতেন। স্বামী বিবেকানন্দও তা-ই করেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মিশনে নারী নিষিদ্ধ ছিল। এখনো আছে। আমার খুবই অবাক লাগে, এই দুই মহাপুরুষ কী করে নারীর গর্ভে জন্মেও নারীদের সাধনার বাধা হিসেবে চিহ্নিত করলেন!
বুদ্ধ বলছেন, সকল প্রাণী সুখী হোক! শক্তিশালী কী দুর্বল, উচ্চ মধ্য বা নিচু গোত্রের, ক্ষুদ্র বা বৃহৎ, দৃশ্য বা অদৃশ্য, কাছের বা দূরের, জীবিত বা জন্ম প্রত্যাশী সকলেই সুখী হোক।
সর্বজীবে কি আমরা আসলেই দয়া করতে পারি? একটা কেউটে সাপ আমাকে ছোবল দিতে আসছে, আমি কি তাকে দয়া করব? তার ছোবল খাব? তাকে মারব না!
কলেরা, টাইফয়েড, সিফিলিসের ভয়ঙ্কর জীবাণুরাও তো জীব। তাদের প্রতি দয়া করতে হলে পেনিসিলিন ব্যবহার করা যাবে না। তাও কি সম্ভব!
নিয়তির পরিহাস হচ্ছে, যে দেশে অহিংস যুদ্ধের জয়জয়কার, চারদিকে তাঁর ধ্যানী মূর্তি, সেখানেই জন্মেছে কঠিনতম হিংসা। আত্মঘাতী বোমা হামলার শুরু শ্রীলংকায়। টাইগার প্রভাকরণের ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ তরুণ-তরুণী শরীরে বোমা বেঁধে নিজেকে উড়িয়ে দিচ্ছে।
গৌতম বুদ্ধের একটি বাণী আমার খুব পছন্দের। তিনি ভক্তদের বলছেন, আমার কথা হলো নদী পার হওয়ার ভেলা। একবার নদী পার হওয়ার পর ভেলা মাথায় নিয়ে বেড়ানোর কিছু নেই।
এই ধর্মের আরেকটি বিষয় আমাকে আলোড়িত করে, পূর্ণচন্দ্রের সঙ্গে এর সম্পৃক্ততা।
আষাঢ়ি পূর্ণিমা : গৌতম বুদ্ধের গৃহত্যাগ।
বৈশাখী পূর্ণিমা : বুদ্ধের মহাজ্ঞান লাভ।
শারদীয় পূর্ণিমা : কঠিন চিবরদান অনুষ্ঠান।
ভাদ্র পূর্ণিমা (মধু পূর্ণিমা) :কঠিন তপস্যার সময় বানররা গৌতম বুদ্ধকে মধু পান করিয়েছে বলে মধু পূর্ণিমা।
আশ্বিনী পূর্ণিমা : বুদ্ধ তার চুল কেটে আকাশে উড়িয়েছিলেন। এই পূর্ণিমায় বৌদ্ধরা আকাশে ফানুস উড়ায়।
মাঘি পূর্ণিমা : এই দিনে বুদ্ধ ঘোষণা করেন, আর তিনমাস পর তাঁর মহাপ্রয়াণ হবে।
ফাল্গুনী পূর্ণিমা : এই তিথিতে বুদ্ধ কপিলাবস্তুতে যান। বাবা-মার সঙ্গে শেষবার দেখা করার জন্যে।
গৌতম বুদ্ধের জন্ম ও মৃত্যু একই দিনে হয়েছিল। কাকতালীয় হলেও দু’বারই আকাশে ছিল পূর্ণচন্দ্র।*
* অভিনেতা এবং আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় ‘বৌদ্ধধর্ম ও পূর্ণিমা’ বিষয়ে আমাকে অনেক সঠিক তথ্যের সঙ্গে একটি ভুল তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, পৌষ পূর্ণিমায় গৌতম বুদ্ধ শ্রীলংকা গিয়েছিলেন। তথ্যটা ভুল। ধর্মপ্রচারের জন্যে গৌতম বুদ্ধ কখনো শ্রীলংকা আসেন নি।