মানুষটিকে সারা পৃথিবী চেনে। তিনি গৌতম বুদ্ধ। রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতায় হুবহু এই ঘটনাটা আছে, কিন্তু তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর কবিতায় স্বামী যখন স্ত্রী-সন্তানকে ফেলে ঈশ্বরের সন্ধানে গৃহত্যাগ করছেন। তখন ঈশ্বর আক্ষেপের সুরে বলছেন–
দেবতা নিঃশ্বাস ছাড়ি কহিলেন, ‘হায়
আমারে ছাড়িয়া ভক্ত চলিল কোথায়?’
আমরা এখন আছি গৌতম বুদ্ধের দেশে। যেখানেই চোখ যায় সেখানেই গৌতম বুদ্ধের ধ্যানী মূর্তি। একেকটি ছ’তলা সাততলা দালানের সমান। প্রতিটি পাহাড়ের চূড়ায় মূর্তি। প্রকাণ্ড সব স্তূপা। স্তূপা নির্মিত হয় বুদ্ধের ব্যবহৃত জিনিসপত্র লুকিয়ে রাখার জন্যে।
ক্যান্ডিতে আছে গৌতম বুদ্ধের পবিত্র দাঁত। নাজমা ভাবি গৌতম বুদ্ধের দাঁত দেখার জন্যে অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তার একটাই কথা, ডলার খরচ করে এসেছি গৌতম বুদ্ধের দাঁত না দেখে ফিরে যাব? এটা কেমন কথা!
আমার কথা হচ্ছে, দাঁত শরীরের একটি মৃত অংশ। অন্য একজন মানুষের দাঁতের সঙ্গে এই পবিত্র দাঁতের কোনো পার্থক্য থাকার কথা না।
নাজমা ভাবি রাগী গলায় বললেন, এটা কী বললেন! আপনার দাঁত আর উনার দাঁত একই?
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, অবশ্যই না। দাঁত থেকে DNA টেস্টের মাধ্যমে যদি জিন স্ট্রাকচার বের করা যায় তাহলে দেখা যাবে দুজনের জিন-গঠন ভিন্ন। চলুন দাঁত দেখতে যাব।
আমি রাজি হলাম, কিন্তু আমার মনের খুঁতখুঁতানি দূর হলো না। খুঁতখুঁতানি প্রধান কারণ, ভূপর্যটক এবং মহান পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ন। তিনি লংকার কলম্বোর একটি বৌদ্ধ বিহারের সম্মানিত শিক্ষক ছিলেন। আঠারো মাস সেখানে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি তার অভিজ্ঞতা আমার জীবন যাত্রা গ্রন্থে লিখে গেছেন।
এই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে গৌতম বুদ্ধের দাঁত প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন, এই দাঁত বুড়ো আঙুলের মতো মোটা। লম্বায় প্রায় দুই ইঞ্চি। এটা মানুষের দাঁত হতে পারে না। মূল দাঁত পর্তুগীজ জলদস্যুরা পুড়িয়ে ফেলে। তারা নকল একটি দাঁত দান করে।
আমরা গৌতম বুদ্ধের দাঁত দেখতে যাচ্ছি–এই খবরে পূত্র নিষাদ অত্যন্ত উল্লসিত হলো। তার উল্লাসের কারণ ধরতে পারলাম না। গৌতম বুদ্ধের বিশাল বিশাল মূর্তি দেখে সে এই ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েছে কি না কে জানে!
আমি তাকে বললাম, বাবা তুমি গৌতম বুদ্ধের দাঁত দেখতে চাচ্ছ কেন?
নিষাদ বলল, সে তার ভাই নিনিতের জন্যে সেখান থেকে দাঁত কিনে ভাইয়ের মুখে লাগিয়ে দেবে। দাঁতের অভাবে তার ভাই চকলেট খেতে পারছে না–এই জন্যে তার খারাপ লাগে।
শেষ পর্যন্ত দাঁত দেখা হলো না। কারণ ড্রাইভার দিগায়ু বলল, বিশেষ বিশেষ দিন ছাড়া এই দাঁত সর্বসম্মুখে বের করা হয় না। আজ সেই বিশেষ দিন না।
গৌতম বুদ্ধের পবিত্র দাঁত দর্শনার্থীরা সবসময় দেখতে পারে। দিগায়ুর মিথ্যা ভাষণে আমার ভূমিকা আছে। গৌতম বুদ্ধের দেখা পাওয়া মহা সৌভাগ্যের ব্যাপার। তাঁর দাঁত দেখার কিছু নেই। যে মঠে গৌতম বুদ্ধের দাঁত আছে, সেখানে তাঁর মাথার চুলও সংরক্ষিত আছে। এই চুল উপহার হিসেবে বাংলাদেশ দিয়েছে শ্রীলংকাকে। বাংলাদেশে গৌতম বুদ্ধের চুল কীভাবে এসেছে সেটা বলা যেতে পারে।
বুদ্ধ এসোসিয়েসনের প্রধান অজিত রঞ্জন বড়ুয়া বলেন, তিব্বতের এক সাধু (শাক্য ভিক্ষু) পবিত্র চুল বাংলাদেশে আনেন ১৯৩০ সালে। আরেক সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম বৌদ্ধ বিহারের ভন্তে শ্রমন (বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের প্রধান) গত শতাব্দীর প্রথম ভাগে রেঙ্গুন থেকে কিছু চুল নিয়ে আসেন।
গৌতম বুদ্ধের চুল বাংলাদেশ থেকে উপহার হিসেবে যাওয়ার অনেক আগেই শ্রীলংকায় এসেছিল। প্রাচীন পলি গ্রন্থ জাতক কথায় বলা হয়েছে ভারতবর্ষের দুই ব্যবসায়ী গৌতম বুদ্ধের একগোছা চুল নিয়ে শ্রীলংকায় আসেন। তাদের একজনের নাম থাপাসু (Thapassu}, অন্যজনের নাম ভালুকা (Bhalluka)। চুল থাকতেও শ্রীলংকা আবার বাংলাদেশ থেকে কেন চুল নিল জানি না।
সম্রাট অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্ম দ্রুত প্রসার লাভ করে। দলে দলে হিন্দুধর্মাবলম্বীরা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করতে থাকেন। এতে শঙ্কিত হয়ে শংকরাচার্য সুন্দর একটা প্যাঁচ খেলেন। তিনি ঘোষণা করেন, গৌতম বুদ্ধ হিন্দুদের অষ্টম অবতার। তিনি হিন্দু সনাতন ধর্মেরই একজন। কাজেই তার কৃপালাভের জন্যে বৌদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের প্রবল স্রোত বাধাগ্রস্ত হলো।
শেষ খেলা খেললেন রাজা অজাতশত্রু। বিচিত্র কোনো কারণে তিনি বৌদ্ধধর্মালম্বীদের উপর ক্ষেপে গেলেন। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করলেন। ঘোষণা করলেন, গৌতম বুদ্ধের অনুসারীদের দেখামাত্রই হত্যা করা হবে।
প্রাণভয়ে ভীত বৌদ্ধ ভিক্ষুরা পালিয়ে পাহাড়-পর্বতের দিকে চলে গেলেন। আজও পাহাড়-পর্বতেই এই ধর্মের মানুষের ঘনত্ব বেশি। সমতলে নেই।
.
এই সময়ে পৃথিবীজুড়েই বৌদ্ধধর্মের প্রতি প্রবল আগ্রহ লক্ষ করা গেছে। পত্রপত্রিকায় প্রায়ই খবর আসছে হলিউডের অমুক তারকা বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছেন। তাদের আগ্রহের মূল কারণ এই ধর্মে ঈশ্বর নেই। সোজা-সাপটা ঈশ্বর নেই বলাটা ঠিক হচ্ছে কি না তাও বুঝতে পারছি না। কারণ এক ভক্ত গৌতম বুদ্ধকে জিজ্ঞেস করল, গুরুজি, ঈশ্বর কি নেই?