বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কাশ্যপের সাধের প্রাসাদে বাস করতে আসেন। তারা সেখানকার নির্জনতায় উপাসনার ফাঁকে ফাঁকে দেয়ালচিত্র ধ্বংস করতে থাকেন। বৌদ্ধধর্মে নারীরা সাধনার বাধা। সেখানে নগ্ন নারীমূর্তির ছবির সামনে উপাসনা অর্থহীন হবেই।
একই ঘটনা রোমের সিসটিন চাপালে ঘটেছিল। গির্জার দেয়ালচিত্র এঁকেছিলেন পৃথিবীর মহান শিল্পীদের একজন–মাইকেল এঞ্জেলো। সেখানে নগ্ন নারীর ছবি। পোপের নির্দেশে সব নগ্ন নারীকে কাপড় পরিয়ে দেওয়া হয়। অনেক বছর পরে কাপড়ের রঙ সরিয়ে অপূর্ব নারীমূর্তি বের করা হয়।
সিগিরিয়া রকের ফ্রেসকো আমি দেখতে পাই নি, সিসটিন চ্যাপেলের বিখ্যাত ফ্রেসকো দেখেছি।
এখন রাজা কাশ্যপ বিষয়ে কিছু বলি। তাঁর বাবা ছিলেন অনুরাধাপুরের নৃপতি। নাম ধাতুসেন। তিনি শুধু যে বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন তা-না, মনেপ্রাণে গৌতম বুদ্ধের বাণীতে বিশ্বাসী ছিলেন। প্রজাহিতকর অসংখ্য কাজ তিনি করেছেন। সাধারণ মানুষের হাসপাতাল তো বানিয়েছেনই, পঙ্গুদের জন্যেও একটা হাসপাতাল বানিয়েছেন। অনুরাধাপুরের মানুষদের জলকষ্ট নিবারণের জন্যে তিনি বৃষ্টির পানি ধরে রাখার বিশাল প্রকল্প শেষ করেন। এই পানি সেচকার্যে ব্যবহার করে অনুরাধাপুর হয়ে উঠল সুজলা-সুফলা। ঐতিহাসিক মাহাওয়ানসা (Mahawansa) বলেছেন, ধাতুসেনের সুকৃতি লিখতে পাতার পর পাতা লাগবে, তারপরেও লিখে শেষ করা যাবে না।
তাঁর পুত্র কাশ্যপ পিতাকে বন্দি করে সিংহাসন দখল করলেন। পিতার উপর প্রবল চাপ প্রয়োগ করলেন তাঁর লুকানো সম্পত্তির জন্যে। একসময় ধাতুসেন বললেন, চলো তোমাকে আমার সম্পত্তি দেখাচ্ছি। তিনি তাকে নিয়ে গেলেন তার তৈরি জলাধারের কাছে। বললেন, ওই দেখো আমার সম্পত্তি।
কাশ্যপ পিতাকে বললেন, আপনি যেন সারা জীবন আপনার লুকানো সম্পত্তি দেখতে পারেন সেই ব্যবস্থা করছি। তিনি লেকের দিকে মুখ ফিরিয়ে পিতাকে জীবন্তু দেয়ালের সঙ্গে প্লাস্টার করে ফেললেন। ধাতুসেন চব্বিশ ঘণ্টা বেঁচেছিলেন।
মোঘল আমলেও এ প্রনের ঘটনা ঘটেছিল। সম্রাট শাহজাহানকে বন্দি করেছেন তাঁর পুত্র আওরঙ্গজেব। শাহজাহানের দিন কাটছে তার নিজের সৃষ্টি তাজমহলের দিকে তাকিয়ে। শাহজাহান ভাগ্যবান, তাঁর পুত্র পিতাকে দেয়ালে প্লাস্টার করে ফেলে নি।
ভাইয়ের সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে কাশ্যপের হাতি হঠাৎ কেন পিছু ফিরল তার ব্যাখ্যা হলো হাতিরা জলাভূমিতে চোরাবালির অস্তিত্ব বুঝতে পারে। হাতির সামনে চোরাবালি পড়েছিল বলেই সে দিক পরিবর্তন করে। এখানে আমার ছোট্ট প্রশ্ন আছে। হাতি চোরাবালির অস্তিত্ব টের পেয়ে পেছনে ফিরে–এই তথ্য কি হাতিটা কাউকে বলে গেছে?
সিগিরিয়া রক একসময় বনেজঙ্গলে ঢাকা পড়ে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। দুজন ব্রিটিশ পর্যটক ১৮৫৩ সালে এর অস্তিত্ব খুঁজে পান। এরপর থেকে প্রতিবছর শত শত পর্যটক এখানে আসেন। মুগ্ধ হয়ে দেখেন যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ১৬০০ বছর আগের অপূর্ব স্থাপত্য
.
পুনশ্চ
দেয়ালচিত্রগুলিতে তিনটি রঙ ব্যবহার করা হয়–লাল, হলুদ এবং সবুজ। একটি মাত্র ছবিতে ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে কালো ব্যবহার করা হয়েছে। কোনো ছবিতে নীল রঙ নেই। এটি চিত্র বিশেষজ্ঞদের বিস্মিত করেছে। কারণ অজন্তার গুহাচিত্র একই সময়ে আঁকা। সেখানে নীল রঙ ব্যবহার করা হয়েছে।
সিগিরিয়া রকে আঁকা ফ্রেসকো বিষয়ে কিছু কথা। দেয়াল তৈরি হওয়ার পর রঙতুলি দিয়ে ফ্রেসকো আঁকা হয় না। দেয়ালে প্লাস্টারের সময় ছবি তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। লাইম স্টোনের আস্তরের সঙ্গেই প্রাকৃতিক রঙ মেশানো হয়। এই কারণেই ছবিতে যদি কোনো ভুল থাকে সেই ভুল শুধরানো যায় না।
সিগিরিয়া রকের দেয়ালচিত্রে বড় কিছু ভুল এই কারণেই থেকে গেছে। যেমন এক তরুণীর দু’টা হাতের বদলে তিনটা হাত। একটা হাত তার বুকের ভেতর থেকে বের হয়েছে।
পাঁচটা আঙুলের বদলে কিছু তরুণীর হাতে দুটা আঙুল। একজনের হাতে ছয়টা আঙুল দৃশ্যমান।
দেয়ালচিত্রগুলো একজন শিল্পী এঁকেছেন, নাকি অনেকের পরিশ্রমের ফসল– তা জানা যায় নি। শিল্পী হারিয়ে গেছেন, তার শিল্পকর্ম সাড়ে তিন হাজার বছর পরেও মানুষকে মুগ্ধ করছে। সেইসব শিল্পী কত না ভাগ্যবান!
ভরা পূর্ণিমা
০৩.
ভরা পূর্ণিমা। জোছনার ফিনকি ফুটেছে। জানালা ভেঙে যশোধরার শোবার ঘরের খাটে জোছনা ঢুকে পড়েছে। তরুণী যশোধরা পুত্র রাহুলকে নিয়ে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। পাশেই তার রূপবান তরুণ স্বামী। স্বামী হঠাৎ জেগে উঠলেন। অপূর্ব জোছনা দেখে তার হৃদয় আবেগে মথিত হলো। সর্ব রূপের আঁধার যে ঈশ্বর তার সন্ধানের জন্যে তিনি ব্যাকুল হলেন। স্ত্রী-সন্তানকে ফেলে গৃহত্যাগের সংকল্প নিয়ে বিছানায় বসলেন। ঘুমের ঘোরে স্ত্রী যশোধরা তাঁর গায়ে হাত রাখলেন। তিনি সাবধানে সেই হাত সরিয়ে রেখে যখন বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে গেলেন তখন পুত্র অব্যক্ত স্বরে ডেকে উঠল, বাবা! তিনি চমকে উঠলেন, কিন্তু সংকল্পচ্যুত হলেন না। গৃহত্যাগ করলেন।
প্রাচীন সেই ভারতে তখন থালা হাতে অনেক ভিক্ষুক পথে পথে ঘুরত। তারা মুখে খাবার চাইত না। গৃহস্থের দিকে থালা বাড়িয়ে দিত।
যশোধরার স্বামী এই কাজটিই করলেন। থালা হাতে মানুষের দরজায় দরজায় ঘুরতে লাগলেন।