কাশ্যপের সেনাপতিরা ভাবল, রাজা যুদ্ধ না করে পালাতে চাচ্ছেন। তারা রাজাকে ফেলে নিমিষের মধ্যে উধাও হয়ে গেল। কাশ্যপ অবাক হয়ে দেখলেন যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি একা। ভাইয়ের হাতে ধরা পড়ার চেয়ে তিনি মৃত্যুকে শ্রেয় মনে করলেন। কোমর থেকে ধারালো ছোরা নিয়ে নিজের গলায় বসিয়ে দিলেন।
কাশ্যপের সেই পাথরের প্রাসাদ আজও দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর অতি বিস্ময়কর স্থান হিসেবে।
.
এই মুহূর্তে আমি আমার সফর সঙ্গীদের নিয়ে সিগিরিয়া রক নামে খ্যাত কাশ্যপের প্রাসাদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি। যেসব পর্যটক দেয়ালচিত্র দেখবে তাদের চার শ’ ফুট উপরে উঠতে হবে।
আমি বললাম, অসম্ভব ব্যাপার। সিগারেট ফুঁকে ফুঁকে ফুসফুস করেছি দুর্বল। বাইপাস অপারেশনে হার্টের অবস্থা নাজুক। নগ্নবক্ষা তরুণীদের ছবি দেখতে গিয়ে অপঘাতে মরার কোনো মানে হয় না। আমি শাওনকে জানালাম, আমার পক্ষে উপরে ওঠার প্রশ্নই আসে না।
সেহেরি আমার চেয়ে এক কাঠি উপরে। সে উপরে উঠবে কি উঠবে না তা না-বলেই স্ত্রীকে রেখে উল্টাদিকে হাঁটা শুরু করল।
নাজমা ভাবি চেঁচাচ্ছেন, এই, তুমি কাউকে কিছু না বলে যাচ্ছ কোথায়? তোমার কি ভীমরতি হয়েছে?
সেহেরি ফিরেও তাকাল না। স্ত্রীকে উপেক্ষা করার তার অসীম সাহস দেখে আমি মুগ্ধ।
নাজমা ভাবি বললেন, হুমায়ুন ভাই, আপনি একটা বুদ্ধি দেন দেখি আমি কী করব। ডলার খরচ করে একটা জিনিস না দেখে চলে যাব? এটা কি ঠিক হবে?
আমি বললাম, অবশ্যই ঠিক হবে না। আপনি উপরে উঠবেন। গাইডরা ঠেলেঠুলে আপনাকে তুলে ফেলবে।
পরপুরুষ গায়ে হাত দিবে–এটা কেমন কথা?
তাহলে নিজেই সাবধানে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকুন। শাওন যাচ্ছে। সে আপনাকে সাহায্য করবে।
নাজমা ভাবি রওনা হলেন। আমি দুই পুত্র নিয়ে বিশাল এক পাথরের উপর বসে আছি। জায়গাটা সমভূমি থেকে অনেক উঁচু। দুজনকে নিয়ে সরু সিঁড়ি বেয়ে নেমে বাসের কাছে যাওয়া সম্ভব না। চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য অপরূপ। দৃশ্যে মন দিতে পারছি না। বারবার একটা সাইনবোর্ডে দৃষ্টি আটকে যাচ্ছে। সেখানে ইংরেজিতে লেখা সাবধান বাণী–
ভয়ঙ্কর ভিমরুলের চাকপ্রধান এলাকা
শব্দ করে তাদের বিরক্ত করবে না।
প্রাণ সংহার হতে পারে।
ভিমরুলদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যেই হয়তোবা নিষাদ গলা উঁচিয়ে কাঁদতে লাগল–মার কাছে যাব! মার কাছে যাব! তার বিকট কান্নায় কনিষ্ঠজনের নিদ্রাভঙ্গ হলো। সে ভাইয়ের সঙ্গে তাল দিয়ে কাঁদতে লাগল। দুই ভাইয়ের কান্নায় ভিমরুলদের শান্তি বিনষ্ট হওয়ার কথা। আমি আতঙ্কিত বোধ করছি। বেড়াতে এসে ভিমরুলের হাতে জীবন দেওয়ার অর্থ হয় না।
আমার দুরবস্থা দেখে শ্রীলংকান এক যুবক পুরুষ এগিয়ে এল। জানতে চাইল বাচ্চা কাঁদছে কেন? [এইংরেজিতে প্রশ্ন, শুদ্ধ ইংরেজি। শ্রীলংকায় শিক্ষার হার শতভাগ]।
আমি বললাম, বড়টি কাঁদছে মার কাছে যাওয়ার জন্যে। ছোটটি ভাইয়ের কান্নায় ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দিচ্ছে। এরা কখনোই আলাদা কাঁদে না, একসঙ্গে কাঁদে।
যুবাপুরুষ বলল, এক হাজার রুপির বিনিময়ে আমি তোমার পুত্রকে ঘাড়ে করে তার মা’র কাছে নিয়ে যেতে পারি। শিশুদের কোলে করে দেয়ালচিত্রের কাছে নিয়ে যাওয়াই আমার জীবিকা।
নিষাদ অপরিচিত এই মানুষটির কোলে চড়ে মার কাছে যেতে রাজি হলো। কান্না থামাল।
বড় ভাই কাঁদছে না, কাজেই ছোটটারও কান্না বন্ধ। আমি যুবককে বললাম, তুমি আরেকজনকে খুঁজে বের করো যে ছোটটাকে কোলে নিয়ে উঠবে। আমার কাছে বেবি ক্যারিয়ার আছে। বাচ্চাকে সেখানে বসিয়ে পিঠে বেঁধে নিলেই হবে।
আমি কল্পনায় দেখছি দুই ভাই মার কাছে উপস্থিত। মা তাদের দেখে বিস্ময়ে খাবি খাচ্ছে। দেয়ালচিত্র তার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেছে। পরিচিতজনদের বিস্মিত করতে আমার সবসময় ভালো লাগে।
বিস্মিত করার পরিকল্পনা কাজে লাগল না। শেষ মুহূর্তে নিষাদ বলল, সে তার বাবাকে ছাড়া যাবে না। কেউ আমাকে কোলে করে সিঁড়ি বাইছে–এই দৃশ্য কল্পনা করে শিউরে উঠলাম। দুই ভাই কাঁদুক! কী আর করা।
.
সরু পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে সাড়ে চার শ’ ফুট ওঠার রোমাঞ্চকর বর্ণনা শাওনের কাছে শুনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম। এত কাছে এসেও দেখা হলো না। বয়স এবং স্বাস্থ্য বাদ সাধল। আনন্দভ্রমণে তিনটি জিনিস লাগে–
অর্থ
বয়স
স্বাস্থ্য
ভ্রমণে বের হওয়ার মতো অর্থবান হতে সাধারণ বাঙালি ছেলের অনেক সময় লাগে। অর্থ যোগাড়ের সামর্থ্য হতে হতে তার বয়স হয়ে যায়, স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে।
শাওনের কাছ থেকে নাজমা ভাবির ভয়াবহ অভিজ্ঞতা শুনলাম। বেচারি দেড়শ’ ফুট পর্যন্ত নিজে নিজেই উঠলেন। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, আমার পক্ষে আর ওঠা সম্ভব না। আমি নেমে যাব।
বললেই নামা যায় না। নামার সিঁড়ি ভিন্ন। তাৎক্ষণিকভাবে তার জন্য দুজন গাইড জোগাড় করা হলো। একজন তাকে সামনে থেকে টানছে। আরেকজন পেছন থেকে ঠেলছে। সাড়ে চার শ’ ফুট ওঠার পর তিনি হতাশ গলায় বললেন,
‘নেংটা মেয়েদের ছবি দেখার জন্য এত কষ্ট করেছি?’ বলেই তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। তাকে নামিয়ে আনতে তিনজন গাইড লাগল। তারা কাঁধে করে উনাকে নামিয়ে ফেলল। গাইডদের কর্মক্ষমতা অসাধারণ।
.
পাঁচ শ’ রক্ষিতার ছবি থেকে মাত্র আঠারোটি টিকে আছে। বাকি ছবি ধ্বংস করেছেন বৌদ্ধভিক্ষুরা। পরাজিত কাশ্যপের বিজয়ী ভ্রাতা সিগিরিয়া রক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের উপহার হিসেবে দান করেন। তিনি বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ছিলেন। গৌতম বুদ্ধের বাণী তাঁকে খুব প্রভাবিত করেছে তা মনে হয় না। তিনি কাশ্যপের প্রতিটি কর্মচারী, তার আত্মীয়স্বজন সবাইকে হত্যা করেন। এই হতভাগ্যের দলে কাশ্যপের স্ত্রী-কন্যারাও ছিল। সর্বমোট সংখ্যা এক হাজার।