.
আমি সারা দিন আমার ঘরের বারান্দায় বসে কাটাব–এই দুঃসংবাদ শুনে নাজমা ভাবির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি হতাশ গলায় বললেন, আপনি তো সারা দিন নুহাশপল্লীর বাংলোর বারান্দাতে বসে সময় কাটাতে পারেন। এত টাকাপয়সা খরচ করে এখানে তাহলে এসেছেন কেন?
অকাট্য যুক্তি। কিন্তু লেখকশ্রেণী যুক্তির বাইরে থাকতে পছন্দ করেন। আমি হ্রদের দিকে তাকিয়ে বারান্দায় বসে রইলাম। আমার সামনে কাগজ-কলম। দেশের বাইরে আমি কখনো লেখালেখি করি না। এই তথ্য জানার পরেও আমি যেখানে গিয়েছি শাওন কাগজ-কলম নিয়ে গেছে। আমার সামনে রেখেছে। শাওনকে খুশি করার জনেই কবিতার কয়েকটি চরণ লেখার ব্যর্থ চেষ্টা করলাম।
আজ দুপুরে হ্রদের নিমন্ত্রণ।
অতিথি আমরা ক’জন।
পুত্র নিষাদ এবং শাওন
শাওনের লেখক স্বামী…
এরপর আর মিলাতে পারছি না। গদ্যলেখক হওয়ার অনেক সুবিধা। মিলানোর চিন্তা নেই। কবিতাটা হয়তো আরও কয়েক লাইন লিখতে পারতাম, তার আগেই দুর্ঘটনা ঘটল। বাঁদর এসে টেবিল থেকে চশমা নিয়ে পালিয়ে গেল। চশমা ছাড়া আমি কাছের জিনিস দেখতে পাই। দূরের কিছুই দেখি না। এখন উপায় কী হবে! আমার হাহাকার ধ্বনি শুনে শাওন বারান্দায় এসে আমাকে আশ্বস্ত করল। সে আমার আরও দুটি চশমা নিয়ে এসেছে।
এখন অতি বিস্ময়কর একটি ঘটনা বলি। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার আগে বারান্দায় গিয়েছি শেষ সিগারেট খেতে। অবাক হয়ে দেখি টেবিলে আমার চশমা। যে বাঁদর চশমা নিয়ে গিয়েছিল সে ফেরত দিয়ে গিয়েছে।
.
পুনশ্চ
কান্ডালাম হোটেলে এক ভোরবেলায় নাশতা খাচ্ছি, বেয়ারা যখন শুনল আমরা বাংলাদেশ থেকে এসেছি তখন আনন্দে তার বত্রিশ দাঁত বের হয়ে গেল। তার আনন্দের কারণ বুঝতে না পেরে আমি জানতে চাইলাম, বাংলাদেশী শুনে এত খুশি কেন?
সে বলল, তোমরা খুব ভালো মারামারি করতে পারো।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। তার কাছে শুনলাম, এই হোটেলে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম এবং ইন্ডিয়ান ক্রিকেট টিম ছিল। তাদের মধ্যে মারামারি লেগে গেল। বাংলাদেশ জিতল। দু’দলের মারামারি থামিয়েছিলেন ক্রিকেটার জাভেদ ওমর।
যেভাবেই হোক দেশ পরিচিতি পাচ্ছে, এটা খারাপ কী!
রাজা কাশ্যপ
০২.
যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ১৬০০ বছর আগে শ্রীলংকার নৃপতি ছিলেন রাজা কাশ্যপ।
কাশ্যপ ছিলেন মহা ভীতুদের একজন। সর্বক্ষণ আতঙ্কে থাকেন কখন জলদস্যুরা আক্রমণ করে। কখনবা ভারত থেকে সৈন্যবাহিনী এসে তার দেশ দখল করে।
তাঁর আসল ভয় সৎভাই ম্যাগলোনাকে। সে ঘোট পাকাচ্ছে কাশ্যপের রাজত্ব দখলের। প্রজারা আবার ম্যাগলোনার অনুগত, কারণ মহারাজা কাশ্যপ রক্ষিতার গর্ভে জন্মেছেন। অন্যদিকে তার সৎভাইয়ের গায়ে আছে রাজরক্ত। প্রজারা রাজরক্তের ভক্ত হয়ে থাকে।
একজন ভীতু মহারাজা কী করেন? বিশাল সৈন্যবাহিনী হাতের কাছে মজুদ রাখেন। কাশ্যপও তাই করেছেন। তাঁর বিশাল সেনাবাহিনী। সবাই হাতিতে চড়ে যুদ্ধে পারদর্শী। শ্রীলংকা হাতির দেশ। রাজা কাশ্যপের আছে দশ হাজার হাতির বিশাল বাহিনী।
একজন ভীতু রাজা তার প্রাসাদ এমন এক জায়গায় নির্মাণ করেন, যেখানে প্রবেশ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। রাজা কাশ্যপ তা-ই করেছেন। ছয়শত ফুট উঁচু এক পাথর কেটে দুর্ভেদ্য প্রাসাদ বানিয়েছেন। প্রাসাদ অনেকটা মৌচাকের চাকের মতো। এই পাথর ‘সিগিরিয়া রক’ নামে ভুবন বিখ্যাত। সিগিরিয়া রকের আরেক নাম ‘লায়ন রক’। পাথরের এই দুর্গের প্রবেশপথটি একটি বিশাল সিংহমূর্তির মতো। সিংহমূর্তির অনেকখানি এখনো টিকে আছে।
ভীতু রাজারা লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করেন। সেই কারণেই কাশ্যপের বেশিরভাগ সময় কাটে দুর্ভেদ্য পাথরের প্রাসাদে। সেখানে আমোদপ্রমোদের সব ব্যবস্থা আছে। তার রক্ষিতার সংখ্যা পাঁচ শ’র বেশি। তার রক্ষিতা হিসেবে আফ্রিকান মোটা ঠোঁট কোঁকড়ানো চুলের মেয়ে যেমন আছে, চাপা নাক চেরাচক্ষুর চৈনিক তরুণীও আছে।
তাঁর নির্দেশে এই পাঁচ শ’ তরুণীর নগ্ন এবং অর্ধনগ্ন চিত্র আঁকা হয়েছে পাহাড়ের গুহায়। এইসব দেয়ালচিত্রের সামনেই গ্রানাইট পাথরের দেয়াল। গ্রানাইট পাথর ঘষে এমন চকচকে করা হয়েছে যে, সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে আয়না। এই আয়নায় দেয়ালচিত্রে আঁকা রক্ষিতাদের ছবি প্রতিফলিত হয়। রাজা কাশ্যপ প্রতি বিকেলে আয়নায় রক্ষিতাদের ছবি দেখে ঠিক করেন আজ রাত কার সাথে কাটাবেন।
পাথরের সুউচ্চ প্রাসাদে কাশ্যপ সুইমিং পুলের ব্যবস্থা করেছেন (আজও টিকে আছে)। সখীদের নিয়ে আনন্দ-স্নানের আয়োজন।
ব্রিটিশ এক ইতিহাসবিদ ভিন্ন কথা বলছেন। তার মতে তরুণীরা সবাই একদিকে যাচ্ছে। কারও কারও হাতে ফুল। তারা যেদিকে যাচ্ছে সেদিকে বৌদ্ধ বিহার পিদুরাগালা, সিগিরিয়া থেকে এক মাইল দূরে। কাজেই তরুণীরা যাচ্ছে বৌদ্ধ বিহারে গৌতম বুদ্ধের মূর্তির কাছে।
ইতিহাসবিদরা মাঝে মাঝে ইতিহাস লিখতে হাস্যকর যুক্তি ব্যবহার করেন। যে গৌতম বুদ্ধ নারীদের সাধনার বিঘ্ন ঘোষণা করেছেন, তার কাছে তরুণীরা যাবে নগ্ন অবস্থায়? শুধু নগ্ন নারীরাই যাবে? পুরুষ যাবে না। কোনো পুরুষের ছবি দেয়ালচিত্রে নেই।
কাশ্যপের দিন আনন্দেই কাটছিল, হঠাৎ খবর পাওয়া গেল সৎভাই হস্তীবাহিনী নিয়ে আক্রমণের জন্যে আসছে। কাশ্যপ তার বিশাল সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হলেন। তখনকার রীতি অনুযায়ী যুদ্ধ পরিচালক হিসেবে হাতির পিঠে রাজা কাশ্যপ আছেন সবার সামনে। তাঁকে অনুসরণ করছে তাঁর বাহিনী। এমন সময় দুর্ঘটনা ঘটল। কাশ্যপের হাতি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ স্থির থেকে পেছনে ফিরল।