আমি দিগায়ুকে বললাম, পথে আমাদের কিছু খেতে হবে। এমন কোনো রেস্টুরেন্ট কি পাওয়া যাবে যেখানে ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করা যায়? আমার সঙ্গে ক্রেডিট কার্ড আছে। ডলার আছে।
দিগায়ু বলল, সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে চেষ্টা করে দেখব।
প্রতি আধঘণ্টা পরপর দিগায়ু একটা রেস্টুরেন্টের সামনে গাড়ি থামাচ্ছে। খোঁজ নেওয়ার জন্যে ছুটে যাচ্ছে এবং মুখ শুকনো করে ফিরে আসছে। আমি প্রমাদ গুনলাম।
অন্ধকার রাস্তা। স্ট্রিট লাইটের ব্যবস্থা নেই। রাস্তাও ভালো না। বাংলাদেশের মফস্বল শহরের রাস্তার মতো খানাখন্দে ভরা। আমরা ঝাঁকুনি খেতে খেতে এগুচ্ছি। ঝাঁকুনির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ভালো। নিনিত ঘুমাচ্ছে। শিশুরা বিচিত্র কারণে ঝাঁকুনি পছন্দ করে।
সেহেরি বলল, আমার ডায়াবেটিস! কিছু না খেলে তো মারা যাব।
আমি বললাম, নিনিতের দুধ আছে। ফিডারে করে বানিয়ে দেই খাও।
সেহেরি হতাশ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে মৌনভাব ধরল। নাজমা ভাবি বললেন, হুমায়ূন ভাই তো ভুল কিছু বলেন নাই। তুমি রোগী মানুষ। তোমার খাওয়া দরকার। দুধ তোমার জন্যে উপকারী। বাচ্চাদের দুধে ফ্যাটও থাকে কম।
সেহেরি ক্ষিপ্ত গলায় বলল, আমি ফিডারে করে দুধ খাব?
নাজমা ভাবি বললেন, তোমার জন্যে এখন গ্লাস পাব কই? হুমায়ূন ভাই জ্ঞানী মানুষ। তিনি না ভেবে-চিন্তে কিছু বলেন না।
সেহেরি বলল, চুপ করো তো!
নাজমা ভাবি বললেন, চুপ করব কেন? চুপ করার কী আছে? আগে তো জীবন রক্ষা করবে, তারপর অন্য কিছু। তোমাকে ফিডারে দুধ খেতে হবে। আমরা আমরাই তো। কেউ তো আর ঘটনা দেখছে না।
প্রিয় পাঠক, সেহেরি ফিডারে দুধ খেয়েছে কি খায় নি তা পরিষ্কার করছি না। সব তথ্য প্রকাশ করতে নেই। তবে আমাদের রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন, গোপন কথাটি রবে না গোপনে।
গভীর রাতে আমরা জেফরি বাওয়ার ডিজাইন করা হোটেলে ঢুকতে শুরু করলাম। মনে হলো সুরঙ্গের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। একসময় গাড়ি থামল। পাথরের প্রকাণ্ড পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে হোটেল। কেমন যেন ভৌতিক দেখাচ্ছে।
ফাইভস্টার হোটেলের লবি হয় আলোঝলমল। দেখামাত্র চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এখানে লবি বলে কিছু নেই। টেবিলের কোণে দু’টি লুঙ্গি পরা মেয়ে বসে আছে। তাদের সামনে টিমটিম করে আলো জ্বলছে। আধো আলো এবং অন্ধকার। সব মিলিয়ে অতি রহস্যময় পরিবেশ।
নাজমা ভাবি কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, হুমায়ূন ভাই! এই কোন জঙ্গলে এনে আপনি তুললেন? তাঁর কথা শেষ হওয়ার আগেই ফল পড়ার মতো গাছ থেকে দুটা বাঁদর পড়ল। নাজমা ভাবি চেঁচিয়ে উঠলেন, এইগুলা কী! এইগুলা কী!
পুত্র নিষাদ বলল, এগুলির নাম মাংকি!
মাংকি দু’টা নিষাদের সামনে এসে দাঁড়াল। মুহূর্তের মধ্যেই নিষাদের হাতের চকলেটের প্যাকেট কেড়ে নিয়ে গাছে উঠে পড়ল।
ভয়ে হোক কিংবা প্রেমবশতই হোক নাজমা ভাবি সেহেরিকে জড়িয়ে ধরে আছেন। দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগছে।
.
অতি দ্রুত আমরা রুমের চাবি পেয়ে গেলাম। রিসিপশনিস্ট মেয়েটি বলল, তোমাদের রুমের একদিকটা পুরোটাই কাচের। স্লাইডিং ডোর। রাতে ঘুমুবার আগে অবশ্যই স্লাইডিং ডোর লক করবে। নয়তো বাঁদর ঘরে ঢুকে জিনিসপত্র নিয়ে যাবে।
নাজমা ভাবি হেঁচকি তোলার মতো শব্দ করে বললেন, হুমায়ূন ভাই, আপনি কোথায় এনে তুলেছেন! রাতে বান্দর ঢুকে তো আমাকে খেয়ে ফেলবে।
সেহেরির ঠোঁটের ফাঁকে ক্ষীণ হাসি। বাঁদর তার স্ত্রীকে খেয়ে ফেলছে–এই দৃশ্য কল্পনায় দেখে তার হয়তো ভালো লাগছে।
ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় রুমে ঢুকলাম। শাওন বলল, হোটেল পছন্দ হয়েছে?
আমি বললাম, ভোর হোক, তারপর বলব।
রুমের সামনের বিশাল বারান্দায় সাত-আটটা বাঁদর এসে বসে আছে। গভীর আগ্রহে তারা নতুন অতিথিদের দেখছে। একটিকে দেখলাম দু’পায়ে ভর দিয়ে মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে। নিষাদ তার দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল, Don’t touch me, সে কিছুদিন হলো স্কুলে যাচ্ছে। তার ইংরেজি স্কুল থেকে শেখা।
পাশের রুমে সেহেরি এবং নাজমা ভাবি। নাজমা ভাবির কঠিন গলা শোনা যাচ্ছে। সেহেরির গলা পাওয়া যাচ্ছে না। ঝগড়া হচ্ছে একতরফা।
আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকীর রাত। রাতটাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্যে কিছু একটা করা দরকার। আমি শাওনের দিকে তাকিয়ে বললাম, একটা গান করো তো।
শাওন বলল, এই অবস্থায়?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
নিষাদ বলল, মা গান করবে না। আমি করব। বলেই সে গান ধরল–
আজকের আকাশে অনেক তারা
দিন ছিল সূর্যে ভরা
আজকের জোছনাটা আরও সুন্দর
সন্ধ্যাটা আগুনলাগা।
শাফিন আহমেদের গাওয়া এই গানটা নিষাদ পুরোটা গাইতে পারে। নিষাদ গান করছে, তার মা’র চোখ ছলছল করছে। আহারে, কী সুন্দর দৃশ্য!
.
ভোর হয়েছে।
আমি চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় বসে আছি। আমার সামনে বিশাল কান্ডালামা লেক। আকাশ ঘন নীল। সেই নীল গায়ে মেখে কান্ডালামা হ্রদ হয়েছে নীল। কী আনন্দময় অপূর্ব দৃশ্য! আমি মনে মনে বললাম, ‘আজ আমি কোথাও যাব না।’
মধ্যবিত্তের বিদেশ ভ্রমণ হলো চড়কিবাজি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘোরাঘুরি। দর্শনীয় যা আছে সব দেখে ফেলতে হবে। কোনোকিছু যেন বাদ না পড়ে। এত টাকাপয়সা খরচ করে এসে বিশ্রামে সময় নষ্ট করা কেন?
ইউরোপ-আমেরিকার ট্যুরিস্টদের দেখি ভ্রমণের সঙ্গে তারা যুক্ত করে বিশ্রাম। রোদে শুয়ে থেকে বই পড়ে। বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ঘুম। ঠান্ডা বিয়ারের গ্লাসে চুমুক।