নাজমা ভাবি শ্রীলংকান বিমানবালাকে খাস বাংলায় বললেন, তারে জিজ্ঞেস করেন কেন? সে কি কিছু জানে? তারে যা দিবেন গবগবায়া খাবে। তার যে ডায়াবেটিস–এটা খাওয়ার সময় মনে থাকে না।
শ্রীলংকার এই বিমানবালার খাঁটি বাংলা বোঝার কোনোই কারণ নেই। ইউনিভার্সল বডি ল্যাংগুয়েজের কারণেই মনে হয় সে বুঝল। দু’ধরনের খাবার এনে নাজমা ভাবির সামনে ধরল। ভাবি ভুরু কুঁচকে বলল, এইগুলা কী? আমাদের দেশের কোনো ফকিরের পোলাও তো এইগুলা খাবে না।
.
বন্দর নায়েকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে নেমে দেখি, আমাকে রিসিভ করার জন্যে শ্রীলংকায় বাংলাদেশ মিশনের কনসুলার অফিসার মীর আকরাম এসেছেন। তার হাতে সুন্দর গিফট র্যাপে মোড়া উপহার। আমার লজ্জার সীমা রইল না। অ্যাম্বেসির লোকজনের গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত থাকা উচিত। একজন লেখককে রিসিভ করতে এয়ারপোর্ট এসে সময় নষ্ট করা উচিত না।
আমি হাসিমুখে (নকল হাসি। এভারেস্টবিজয়ী মুসা ইব্রাহিম যে হাসি হেসে ছবি তোলেন।) আকরাম সাহেবের হাত থেকে উপহার নিলাম। ছবি উঠল। আমি এবং শাওন আবার হাসিমুখে একই গিফট নিলাম। আবারও ছবি উঠল। পুত্র নিষাদকে মাঝখানে রেখে তৃতীয়বারের মতো গিফট নেওয়া হলো। নকল হাসির বাজার বসে গেল।
গিফট হাতে নিয়ে আমি হতভম্ব। সেখানে লেখা–হুমায়ুন স্যার এবং শাওন ভাবির বিবাহবার্ষিকীতে শুভেচ্ছা। পৃথিবীর বেশির ভাগ স্বামীর মতো আজকের দিনটি আমার মনে নেই। এতক্ষণে দুয়ে দুয়ে চার হলো। শাওন কেন এই দিনেই শ্রীলংকা যাওয়ার ব্যবস্থা করল, কেন আমাকে ভ্রমণসংক্রান্ত কিছুই জানায় নি, কেন আমার কাছ থেকে কোনো টাকাপয়সা নেয় নি–সব পরিষ্কার। শ্রীলংকায় প্রমোদ ভ্রমণ বিবাহবার্ষিকীতে আমাকে দেওয়া শাওনের উপহার। এখন আমার উচিত তার দিকে প্রেমপূর্ণ নয়নে তাকানো, তা পারছি না। কারণ কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীলংকার বাদরের মতোই আমার গলায় ঝুলে তারস্বরে চিৎকার শুরু করেছে। তার ডায়াপারের ফাঁক দিয়ে হলুদ রঙের সিরাপের মতো কী যেন নামছে। তার বড় ভাই কিছুক্ষণ পরপর আমার শার্টে হ্যাঁচকা টান দিয়ে বলছে, বাবা! আমি এখন কী খাব?
[পাঠক-পাঠিকারা নিশ্চই কৌতূহল বোধ করছেন, গিফট র্যাপে মোড়া উপহারটা কী জানার জন্যে। তাদের কৌতূহল মেটাচ্ছি। উপহার হলো একটা ফটোফ্রেম। ফটোফ্রেমের বিশেষত্ব হচ্ছে ফ্রেম বানানো এলাচির খোসা দিয়ে। গরম মসলার দেশে সব কিছুতে গরম মসলা থাকবে এটাই তো স্বাভাবিক।]
আকরাম সাহেব আমাদের জন্যে গাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। (সাড়ে চার শ’ ডলারে চুক্তি। সাত দিন গাড়ি থাকবে আমাদের সঙ্গে।) নয় সিটের বিশাল গাড়ি। গাড়ির চালক সুদর্শন যুবা পুরুষ, নাম ‘দিগায়ু’। আমি চালককে বললাম, তোমার নামের অর্থ কি দীর্ঘ জীবন?
চালক অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি কীভাবে জানলে?
দীর্ঘায়ু থেকে দিগায়ু– এটি আর ব্যাখ্যা করলাম না। আমার নজর সেহেরির দিকে। সে চোখের ইশারায় আমাকে কী যেন বলতে চাচ্ছে। মেয়েদের চোখের ভাষা সহজেই পড়া যায়, পুরুষদেরটা পড়া যায় না। এক পর্যায়ে সেহেরির চোখের ভাষা বুঝতে পারলাম। সে তার স্ত্রীর পাশে বসতে চাচ্ছে না। আলাদা বসতে চাচ্ছে। আমি বললাম, সেহেরি! তুমি ড্রাইভারের পাশে বসো।
নাজমা ভাবি বললেন, এটা কেমন কথা! স্বামী-স্ত্রী বসবে পাশাপাশি, এটাই নিয়ম।
আমি বললাম, প্রবাসে নিয়ম নাস্তি। এর অর্থ বিদেশে কোনো নিয়ম নেই।
নাজমা ভাবি বললেন, আপনারা তো স্বামী-স্ত্রী ঠিকই পাশাপাশি বসেছেন।
আমি বললাম, আমাদের দুজনের মাঝখানে ডাবল হাইফেনের মতো দুই পুত্র।
নাজমা ভাবি মুখ ভোঁতা করে পরিস্থিতি মেনে নিলেন। আমাদের টিম লিডার শাওনের নির্দেশে গাড়ি চলতে শুরু করল। আমরা যাচ্ছি ‘ডাম্বুলা’। সেখানে কোন হোটেলে উঠব, দর্শনীয় কী দেখব, কিছুই জানি না। টিম লিডার জানেন এটাই যথেষ্ট।
শাওন বলল, ডাম্বুলা যেতে আমাদের লাগবে মাত্র আড়াই ঘণ্টা। আমরা উঠব পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর হোটেলগুলির একটিতে। হোটেলটা ডিজাইন করেছেন পৃথিবীর সেরা আর্কিটেক্টদের একজন, তাঁর নাম জেফরি বাওয়া। হোটেলের নাম হেরিটেন্স কাভালামা। প্রায় বছরই এটি পৃথিবীর সেরা পরিবেশবান্ধব হোটেল হিসেবে ইউনেস্কো পুরস্কার পায়।
কী মনে করে আমি দিগায়ুকে জিজ্ঞেস করলাম, ডাম্বুলা যেতে আমাদের কতক্ষণ লাগবে।
সে বলল, সাত থেকে আট ঘণ্টা।
আমি টিম লিডারের দিকে তাকালাম। টিম লিডার বললেন, আমি সব তথ্য পেয়েছি ইন্টারনেটে। এক্ষুণি তোমাকে দেখাচ্ছি।
সে তার আইফোন নিয়ে টেপাটিপি করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে তার মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। সে জানাল তার আইফোন কাজ করছে না।
আমি দিগায়ুকে বললাম, আমরা দীর্ঘ ভ্রমণে রওনা হয়েছি, ধরো কোনো কারণে গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল, তখন আমরা কী করব?
দিগায়ু বলল, আমি কোম্পানিকে টেলিফোন করে দিলেই অন্য গাড়ি চলে আসবে। তবে ছোট্ট সমস্যা হয়েছে।
কী সমস্যা?
হাত থেকে পড়ে আমার মোবাইল ফোন নষ্ট হয়ে গেছে।
আমি বললাম, চমৎকার। ধরা যাক কয়েকটা ইঁদুর এবার।
দিগায়ু বলল, কী বললে বুঝলাম না।
আমি বললাম, বাংলা ভাষায় আনন্দ প্রকাশ করলাম।
ততক্ষণে আনন্দের বদলে আতঙ্ক আমাকে গ্রাস করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবার ক্ষুধা পাবে। সঙ্গে শ্রীলংকার কোনো টাকা নেই। এয়ারপোর্টে ডলার ভাঙানো হয় নি, কারণ টিম লিডারের নির্দেশ পাওয়া যায় নি।