নাজমা ভাবি বললেন, এটা হুমায়ুন ভাইয়ের একটা সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্র। আমরা যাতে বাবা আদমের কাছে যেতে না পারি তার জন্যে বইয়ের দোকানে দেরি করেছেন। বিরাট সোয়াব থেকে বঞ্চিত হলাম।
আমি মৌনভাব ধারণ করলাম। গৌতম বুদ্ধের দেশে ঘনঘন মৌনভাব ধারণ করতে হয়।
.
আমাদের হোটেলের নাম ক্লাব ডলফিন হোটেল। ফাইভস্টার হোটেল। নিগাম্বুতে এটিই সবচেয়ে সুন্দর হোটেল। এদের মতো বড় সুইমিং পুল সার্কভুক্ত কোনো দেশে নেই। রাত আটটায় হোটেলে পৌঁছলাম। হোটেলের লবি দেখে মন ভালো হয়ে গেল। ছেলেমানুষের মতো হাততালি দিয়ে বলতে ইচ্ছা করল, কী সুন্দর! কী সুন্দর!
হোটেলে রুম না নিয়ে আমরা একটা ভিলা নিয়েছি। ভিলায় সবাই থাকব। সমুদ্র দেখব। আলাদা কিছু খেতে ইচ্ছা করলে রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থা। প্রতিটি ভিলার জন্যে আলাদা অ্যাটেনডেন্ট।
জিনিসপত্র সব নামানো হয়েছে। শাওন গিয়েছে চেক ইন কাউন্টারে। সেখানে তাকে বলা হলো, তোমার নামে কোনো বুকিং নেই।
শাওন বলল, নিশ্চয়ই তোমাদের কোনো ভুল হয়েছে।
মাডাম, ভুল হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
শাওন বলল, এই হোটেলের ম্যানেজমেন্ট অফিস কলম্বোয়। আমি তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। যার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি তার নাম জোসেফ। তার মাধ্যমে আমরা একটা ভিলা নিয়েছি।
ম্যাডাম, আপনার কথা ঠিক আছে। আমাদের হেড অফিস কলম্বো এবং জোসেফ হেড অফিসেই কাজ করেন। কিন্তু ক্রিসমাসের কারণে আজ আমরা ওভার বুকড।
শাওন বলল, আমাদের সঙ্গে বাংলাদেশের খুব বড় একজন লেখক আছেন। আপনারা তার কথা বিবেচনা করবেন না?
হোটেল ম্যানেজমেন্টের সবাই একসঙ্গে সেহেরির দিকে তাকাল। সেহেরি উদাস ভঙ্গিতে মেহেদি রঞ্জিত দাড়িতে আঙুল বুলাচ্ছে। তাকে দেখাচ্ছে বেঁটে টলস্টয়ের মতো।
বেটে টলস্টয় দেখিয়েও লাভ হলো না। জিনিসপত্র তুলে আমরা অন্য হোটেলের সন্ধানে বের হলাম। শুরু হলো ক্লান্তিকর অনুসন্ধান পর্ব।
বিভিন্ন হোটেলের সামনে গাড়ি থামছে। আমরা গাড়িতে বসে আছি। ড্রাইভার দিগায়ুর সঙ্গে চিন্তিত মুখে শাওন নামছে। আর চিন্তিত মুখ করে ফিরছে।
এ রকম চলতেই থাকল, আমরা হোটেলের পর হোটেল দেখতেই থাকলাম। ক্রিসমাস সিজন। সব হোটেল ওভার বুকড। নাজমা ভাবি বললেন, হুমায়ূন ভাই, যদি হোটেল না পাওয়া যায় তখন কী হবে?
আমি বললাম, গাড়ি তো আছে। আমরা গাড়িতে থাকব।
বাথরুম করব কোথায়?
গাড়িতেই করবেন। তারপর নাকে রুমাল চাপা দিয়ে রাতটা পার করবেন।
নাজমা ভাবি বললেন, আপনার সঙ্গে কোনো বিষয়ে কথা বলাই উচিত না।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, কথা সত্য।
রাত বারোটায় প্যারাডাইস বিচ হোটেলের লবি থেকে শাওন ছুটতে ছুটতে গাড়ির কাছে এসে বলল, “পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে?” সে যখন আর্কিটেকচারে ব্যাচেলর ডিগ্রি পেয়েছিল তখনো মনে হয় এত অনিন্দিত হয় নি।
হোটেলে রুম পাওয়ার পেছনে ইউরোপের প্রবল তুষারপাতের বড় ভূমিকা আছে। সুইডিস এক পরিবার চারটি রুম বুক করেছিলেল। তুষারপাতের কারণে তাদের ফ্লাইট বাতিল হওয়ায় তারা হোটেল বুকিং ক্যানসেল করেছে। ঘটনা ঘটেছে শাওনের হোটেল লবিতে পা দেওয়ার পাঁচ মিনিট আগে। হোটেলের লবি ম্যানেজার শাওনকে বলল, তুমি অত্যন্ত ভাগ্যবতী মেয়ে। সুইডিস পরিবার বুকিং ক্যানসেল না করলে তুমি কোথাও থাকার জায়গা পেতে না।
শাওন হাসতে হাসতে বলল, আমি না, আমার স্বামী ভাগাৰান। সে কখনো কোথাও কোনো বিপদে পড়ে না।
.
অন্যদের কথা জানি না। আমি এই হোটেলে খুবই আনন্দে ছিলাম। দু’দিন দু’রাত কাটিয়েছি–দুটি বই পড়ে শেষ করেছি। একটি জনাথন লাইওনস-এর লেখা The House of Wisdom, অন্যটার নাম Between Eternities, লেখক Ashuin Desai. দুটিই চমৎকার বই।
নিগাম্বু এলাকাটা কক্সবাজারের মতো। অসংখ্য স্যুভেনিয়ারের দোকান। দাম নিয়ে মুলামুলি জায়েজ। গায়ে গা লাগা ভিড়।
.
আমার শ্রীলংকা ভ্রমণ এই হোটেলেই ইতি। এখান থেকে ঢাকার দিকে রওনা হব। বিদেশ যাত্রা শেষে দেশে ফেরার সময় সবসময় আমি আনন্দিত থাকি। আমার মনে হয়, দেশ মা আমাকে অনেক দিন না দেখে মন খারাপ করে আছে। অভিমানী মার মন খারাপ ভাব দূর করতে হবে। তাড়াতাড়ি দেশের মাটিতে পা দিতে হবে।
আমার জন্যে শ্রীলংকা ভ্রমণ ছিল আনন্দময় অভিজ্ঞতী। ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্যে শাওনকে ধন্যবাদ। নাজমা ভাবির নানান কর্মকাণ্ডে আনন্দ পেয়েছি। তাকেও ধন্যবাদ। তিনি অবশ্যি শেষ পর্যন্ত হাতির বাচ্চাদের স্নান দেখতে পান নি। আমি তাঁকে কথা দিয়েছি, আরেকবার তাঁকে নিয়ে শুধুমাত্র হাতি দেখার জন্যেই আসব। যেখানেই হাতি সেখানেই আমরা।
ধলবাদ শ্রীলংকার সহজ-সরল মানুষদের। প্রকৃতিকে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। প্রকৃতি মানুষের ধন্যবাদের ধার ধারে না। তারপরেও পৃথিবীতেই যিনি স্বর্গচারণ বানিয়েছেন তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। বিজ্ঞান কল্পকাহিনীর মহান লেখক আর্থার সি ক্লার্ক কেন নিজ দেশ ফেলে সারা জীবন শ্রীলংকায় কাটিয়েছেন–তা এই দেশে পা না দিলে বুঝতে পারতাম না।
আমার কথা ফুরাল
নটে গাছটি মুড়াল
কেন যে নটে মুড়ালি ….
ইত্যাদি।
.
পুনশ্চ
শ্রীলংকার একটি লোককাহিনী দিয়ে দিলাম। অনুবাদ করেছেন বিপ্রদাশ বড়ুয়া। প্রকাশ করেছে সাহিত্য প্রকাশ।