নাজমা ভাবি বললেন, আচ্ছা ঢুকব না। শাওন ফ্রেম করে যেই ছবি তুলতে গেছে, নাজমা ভাবি ডানদিক থেকে টুকে মিষ্টি হাসি হেসেছেন।
শাওনের তোলা একশ’ ছবির আশিটিতে নাজমা ভাবি আছেন। শাওন এখন চেষ্টা করছে ফটোশপের মাধ্যমে ভাবিকে মুছে ফেলতে। একটা ছবিতে কিছু সাফল্য এসেছে। ভাবির শরীর মুছে গেছে, শুধু মুখটা পিলারের মাথায় আটকে আছে। মুখ দূর করা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে অনুরাধাপুরের একটা পিলার সবার দিকে তাকিয়ে হাসছে। ছবি হিসেবে চমৎকার।
আদম’স পিক
০৯.
বেনটোটা থেকে আমরা যাব নিগাম্বু। কলম্বো হয়ে যেতে হবে। কলম্বোর কাছেই রত্নপুরা। রত্নাপুরাতে আছে রত্নগিরি বা রত্নের পাহাড়। পাহাড় খুঁড়লেই মণিমুক্তা। কলম্বো যাওয়ার পর রত্নপাহাড় দেখা যায়। এই রত্নগিরিই বিখ্যাত আদম’স পিক। অনেক উঁচু পাহাড়। উপরে ওঠা অসম্ভব ব্যাপার। পাহাড়ের নিচে ঘুরাফিরা করে নিগাম্বু চলে যাওয়া। সঙ্গে গাড়ি আছে, সমস্যা কিছু নেই।
আদম’স পিক সম্পর্কে কিছু বলা যাক। সাত হাজার তিন শ’ আটান্ন ফুট উঁচু পাহাড়। এর চূড়ায় একটি পদচিহ্ন।
মুসলমানরা দাবি করেন এই পদচিহ্ন হযরত আদমের। বেহেশত থেকে নির্বাসিত হয়ে তিনি এসেছেন শ্রীলংকায়।
খ্রিষ্টানদেরও এই দাবি। তাদের মতে শ্রীলংকাই হলো স্বর্গভূমি (Eden)। খ্রিষ্টানদের একটি দল অবশ্য বলে এটি সেইন্ট পিটারের পায়ের ছাপ।
বৌদ্ধদের দাবি এটি গৌতম বুদ্ধের বাঁ পায়ের ছাপ। তিনি পৃথিবী থেকে শেষবারের মতো চলে যাওয়ার সময় বাঁ পা রাখেন এখানে, ডান পা রাখেন ব্যাংককের সারাবুড়ি প্রদেশে। সেখানে পাথরের ওপর ডান পায়ের একটি ছাপ আছে।
হিন্দুদের দাবি এই পায়ের ছাপ শিবের। পাহাড়ের নিচে একটি প্রাচীন শিবমন্দিরও আছে।
প্রধান ধর্মগুলির মধ্যে ইহুদি ছাড়া বাকি সবাই পদচিহ্নের দাবিদার। ইহুদিরা যদি বলত এটি মোসেসের (মুসা আলায়েস সালাম) পায়ের ছাপ, তাহলে সর্বকলা সম্পন্ন হতো।
আমার নিজের ধারণা, এটা কোনো মানুষের পায়ের ছাপই না। প্রাকৃতিক কারণে শিলা ক্ষয়ে পায়ের পাতার আকৃতি নিয়েছে। কিংবা মানুষই পাথর খুদে এই জিনিস বানিয়েছে।
আমার এই ধারণার কারণ পায়ের পাতা পাঁচ ফুট লম্বা। দৈত্যের পায়ের পাতা এত বড় হতে পারে, মানুষের না।
ধার্মিক সেহেরি বলল, আদি মানুষ ৬০ ফুট লম্বা ছিল। তাদের পায়ের পাতা তো পাঁচ ফুট লম্বা হবেই।
আমার যুক্তি, এক মিলিয়ন বছর আগে মানুষের দৈর্ঘ্য আমাদের মতোই ছিল। গুহাচিত্রে আঁকা ছবিগুলিই তার প্রমাণ। গুহাচিত্রে শিকারি মানুষ বাইসন, হাতি, হরিণ তাড়া করছে। ছবিতে আঁকা হাতি বা বাইসনের দৈর্ঘ্য এবং মানুষের দৈর্ঘ্যের অনুপাত এই সত্যই প্রতিষ্ঠিত করে।
বিজ্ঞানের কল্যাণে আমরা জানি প্রাচীন মানুষ ছিল ক্ষীণায়ু এবং খর্বাকৃতির। পুষ্টির অভাব, চিকিৎসার অভাব, যুদ্ধ, মহামারী–সব মিলিয়ে মানুষের গড় আয়ু ছিল পঁচিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে।
বিজ্ঞানের কল্যাণে মানুষ আজ দীর্ঘায়ু। লম্বাতেও মানুষ বাড়ছে। চীন এবং জাপান হলো উজ্জ্বল উদাহরণ। চীনের যুবকরা তো লম্বায় এখন আমেরিকানদের ধরে ফেলছে।
.
কলম্বোর দিকে যাত্রা শুরুর আগে আগে আমি বললাম, শ্রীলংকায় এসে ট্রেনে চড়া হয় নি। বেনটোটা থেকে ট্রেনে কলম্বো গেলে কেমন হয়? দিগায়ু গাড়ি নিয়ে আগে আগে চলে গেল।
সেহেরি বাদ সাধল। সে বলল, ট্রেন প্লাটফরম থেকে উঁচুতে থাকে। ট্রেনের সিঁড়ি সরু। তোমার ভাবি উঠতে পারবে না।
আমি বললাম, দুজন ভাবিকে নিচ থেকে ঠেলবে, আমি তাকে উপর থেকে টানব। টানা এবং ঠেলা খেয়ে সিঁড়ি বাওয়া তো ভাবির অভ্যাস আছেই।
নাজমা ভাবি বললেন, আপনার সব কথা আমি শুনব। শুধু যদি আপনি হাতি দেখাবার ব্যবস্থা করে দেন।
শাওন বলল, ভাবি, ওকে এসব কিছু বলে লাভ নেই। ট্যুর প্রোগ্রাম আমি করেছি। নিগাম্বু থেকে আমরা যাব পিনাওয়ালায়। সেখানে আছে হাতির বাচ্চার এতিমখানা। যে সব হাতির বাচ্চার মা মারা গেছে কিংবা হারিয়ে গেছে তাদের এই হস্তী এতিমখানায় রাখা হয়। তাদের খাওয়ার দৃশ্য, স্নানের দৃশ্য অসাধারণ।
নাজমা ভাবির চোখ চকচক করছে। মনে হয় তিনি কল্পনায় হস্তীস্নান দৃশ্য দেখছেন।
চার কামরার ছোট্ট ট্রেন। কামরাগুলির অবস্থা শোচনীয়। মন খারাপ করে ট্রেনে উঠলাম। ট্রেন চলতে শুরু করামাত্র মন ভালো হয়ে গেল। সমুদ্র ঘেঁসে ট্রেনের লাইন। শান্ত নীল সমুদ্র, সমুদ্রের পাড়ে জেলেপল্লী। দৃশ্যপট বদলাচ্ছে। সমুদ্র বদলাচ্ছে না। অনেকদিন ট্রেনে এমন আনন্দভ্রমণ হয় নি।
একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। ট্রেনের টিকিট ব্রিটিশ আমলের ট্রেনের টিকিটের মতো। এক ইঞ্চি বাই দুই ইঞ্চি হার্ডবোর্ডে ছাপানো। টিকিটের রঙ বলে দিচ্ছে কোন ক্লাস। হলুদ রঙ হলে থার্ড ক্লাস, নীল হলে সেকেন্ড ক্লাস। আমি কলেজে পড়া পর্যন্ত এই টিকিটের চল আমাদের দেশে দেখেছি।
চমৎকার রেলস্টেশনের ছবি দেখে পাঠক বিভ্রান্ত হবেন না। শ্রীলংকার স্টেশনগুলির দীন দশা। এই স্টেশন হোটেল সেরেনডিয়া তাদের প্রচারের জন্যে করে দিয়েছে।
কলম্বোয় পৌঁছে টিম লিডার শাওন ম্যাডাম আমাদের এক ঘণ্টা সময় দিলেন। এই এক ঘণ্টার মধ্যে দুপুরের খাওয়া শেষ করতে হবে। কারোর কেনাকাটার কিছু থাকলে এর মধ্যেই সারতে হবে। আমি কলম্বোর একটা বইয়ের দোকানে ঢুকলাম। বইয়ের সংগ্রহ ভালো। বেছে বেছে বই কিনতে হয়। বই বাছাবাছি করতে অনেক সময় চলে গেল। এখন আদম’স পিকের দিকে রওনা হলে হোটেলে পৌঁছতে রাত দুটা বেজে যাবে। কাজেই আদম’স পিক বাদ দিয়ে হোটেলের দিকে রওনা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো।