ভাবি একা আমাদের সঙ্গে ঘুরছেন। সেহেরি গাড়ি থেকে নামে নি। তার পক্ষে নাকি মাইলের পর মাইল হাঁটা সম্ভব না।
শাওন মহা উৎসাহে ছবি তুলে বেড়াচ্ছে। তার বুকে বেবি ক্যারিয়ারে পুত্র নিনিত ঝুলছে। তার বড়ভাই কাঁদছে না দেখে নিনিতও চুপচাপ। চোখ বড় বড় করে ধ্বংসস্তূপ দেখছে।
আমি নাজমা ভাবিকে বললাম, চলুন, আপনার কিছু ডলার উসুলের ব্যবস্থা করি। বোধিবৃক্ষ দেখে আসি।
নাজমা ভাবি বললেন, বোধিবৃক্ষ আবার কী?
যে বৃক্ষের নিচে সাধনা করে গৌতম বুদ্ধ নির্বাণ লাভ করেছিলেন।
সেটা কি এই দেশে?
না। তবে অশোককন্যা সংঘমিত্রা তার একটা ডাল এনে অনুরাধাপুরে লাগিয়েছিলেন। এই গাছটিকেও পবিত্র গণ্য করা হয়। অনেকেই এই গাছের কাছে আসেন পুণ্য লাভের আশায়।
আমরা মুসলমান। আমরা কেন পুণ্য পাব?
তা হয়তো পাবেন না, তারপরেও ভুবনবিখ্যাত একটা বৃক্ষ দেখার আনন্দ তো পাবেন।
বোধিবৃক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে নাজমা ভাবি বললেন, এটা তো একটা বটগাছ। বটগাছ তো কত দেখেছি।
আমি বললাম, বটগাছ না। এটা অশ্বত্থগাছ। ভাবি বললেন, অশ্বত্থ গাছও তো দেখেছি।
আমি বললাম, শ্রীলংকার অশ্বত্থগাছ তো দেখেন নি। বাংলাদেশে কত হাতি দেখেছেন, তারপরেও শ্রীলংকার হাতি দেখার জন্যে আপনি অস্থির।
ভাবি বললেন, হুমায়ুন ভাই, আপনি আমাকে ভোলাচ্ছেন। আপনার মতলব আমি টের পাচ্ছি। আপনি আমাকে হাতি দেখতে দিবেন না। তা হবে না। আমি কিন্তু হাতি দেখব। শ্রীলংকায় এসে হাতি না দেখে গেলে আত্মীয়স্বজনের কাছে মুখ দেখাতে পারব না।
.
অনুরাধাপুরের ইতিহাস লিখে পাঠকদের বিরক্ত করছি কি না বুঝতে পারছি না। ভ্রমণকাহিনীর লেখকরা অনেকটা ট্যুরিস্ট গাইডের মতো। গাইডরা টুরিস্টদের সুন্দর সুন্দর জায়গায় নিয়ে বকরবকর করতে থাকে। ভ্রমণকাহিনীর লেখকরা পাঠকদের সুন্দর সুন্দর জায়গায় নিয়ে লেখার মাধ্যমে বকরবকর করতে থাকেন। গাইডদের সঙ্গে তাদের তফাত হচ্ছে গাইডদের ধমক দিয়ে থামানো যায়, লেখকদের যায় না
প্রিয় পাঠক! বেশি বিরক্ত করব না। অনুরাধাপুরের ইতিহাসের মজার অংশটা (আমার কাছে) খুবই অল্প কথায় বলব।
অনুরাধা নামটা শুনলেই মিষ্টি চেহারার একটি মেয়ের ছবি মনে আসে। অনুরাধা আসলে একজন অত্যন্ত বলশালী পুরুষের নাম। তার নামে যে নগরের প্রতিষ্ঠা তা-ই হচ্ছে অনুরাধাপুর। চব্বিশ শতাব্দী বছর আগের প্রতিষ্ঠিত এই নগরী দর্শনার্থীদের এখনো বিমুগ্ধ করে যাচ্ছে। আমরা অবাক হয়ে ভাবছি, মানুষ তখনো এত ক্ষমতাধর ছিল!
মৃত নগরী দেখার একটি বিশেষ পদ্ধতি আছে। নগরীর কোনো নির্জন অংশ বেছে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ধ্যান করতে হয়। তখন হঠাৎ মৃত নগরী জীবন ফিরে পায়। যে ধ্যান করছে তার কানে জীবন্ত নগরীর নানা শব্দ, বাদ্য-বাজনা ভেসে আসে। আমি তা-ই করলাম। নির্জন একটা জায়গায় চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছি, তখন এক ইউরোপীয় টুরিস্ট এগিয়ে এসে চিন্তিত গলায় বলল, Any problem man? আমাকে ধ্যানভঙ্গ করে তাকাতে হলো। মৃত নগরীকে জীবিত করা গেল না।
গাইড ব্যস্ত হয়ে পড়ল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শুয়ে থাকা বুদ্ধ দেখানোর জন্যে।
বুদ্ধমূর্তি দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, তারপরেও গেলাম দেখতে।
গাইড বলল, অনুরাধাপুরে গৌতম বুদ্ধের পবিত্র দাঁত ছিল। এখন আছে ক্যান্ডিতে।
আমি বললাম, তোমাকে তো প্রশ্ন না করলে চুপ করে থাকতে বলেছি। কথা বলছ কেন?
গাইড বলল, না বললে তুমি তো জানতে না এখানে উনার পবিত্র দাঁত ছিল।
আমি বললাম, দাঁত যিনি নিয়ে এসেছিলেন আমি তার নাম জানি। তুমি কি জানো?
না। উনার নাম কী?
আমি বলা শুরু করলাম। পাঠক নিশ্চয়ই ভুরু কুঁচকে ভাবছেন, “হুঁ বুঝলাম। জ্ঞান ফলানো শুরু হয়েছে।” আমি জ্ঞান ফলানোর জন্যে কিছু বলছি না। গাইডের কাছে জ্ঞান ফলানোর কিছু নেই। আমার লক্ষ্য শাওন। পৃথিবীর সব স্বামীর মতো আমিও স্ত্রীকে মুগ্ধ করতে ভালোবাসি। এই সুযোগ তেমন হয় না। আজ হয়েছে। শাওন ক্যামেরা হাতে এগিয়ে এসেছে আমার গল্প শুনতে।
আমি ভাব নিয়ে বললাম, যিশু খ্রিষ্টের জন্মের ৫৪০ বছর আগে বুদ্ধকে দাহ করা হয়। আগুন থেকে তাঁর একটি দাঁত এবং কলার বোন রক্ষা পায়। কলিঙ্গ অর্থাৎ বর্তমান উড়িষ্যার রাজা এই দুটি সংগ্রহ করেন এবং গভীর যত্নে রক্ষা করতে থাকেন। কলিঙ্গের রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন পাশের এক নৃপতি। যুদ্ধে হেরে গেলে দাঁত এবং কলার বোন হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে বলে তিনি তাঁর কন্যা রানী ওয়ালিয়াম কুমারীকে তীর্থযাত্রী সাজিয়ে শ্রীলংকায় পাঠিয়ে দেন। রানী ওয়ালিয়াম কুমারীর ছিল মাথাভর্তি লম্বা চুল। তিনি সেই চুলের ভেতর দাঁত এবং কলার বোন লুকিয়ে শ্রীলংকায় চলে আসেন। অনুরাধাপুরের নৃপতি তখন রাজা শ্রীমেঘাওয়ানা। তাঁকে এই দুই পবিত্র বস্তু দেওয়া হয়। এই হলো ঘটনা।
শাওন বলল, কলিঙ্গের রাজা কি যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিলেন?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
শাওন মুগ্ধকণ্ঠে বলল, তুমি এত পড়াশোনা কখন করলে? আই এ্যাম ইমপ্রেসড।
আমি তৃপ্তির হাসি হাসলাম। যাক, অনুরাধাপুরে আসা সার্থক হয়েছে।
.
পুনশ্চ
অনুরাধাপুরের প্রায় একশ’ ছবি শাওন তার ডিজিটাল ক্যামেরায় তুলেছে। মৃত নগরীর আর্কিটেকচারাল বিউটি তাকে বিমোহিত করেছে। সে অনেক খাটাখাটনি করে ফ্রেম করে যখনই ছবি তুলতে যায়, তখনই নাজমা ভাবি ফ্রেমে ঢুকে পড়ে মিষ্টি হাসি হেসে পোজ দেন। একবার শাওন বলল, ভাবি আপনি বাঁ-দিক দিয়ে ঢুকবেন না। বাঁ-দিকের এই পিলারটা আমার ফ্রেমের শেষ অংশ।