আমি দিগায়ুর দিকে তাকিয়ে বললাম, আমরা সেখানে যাব না। আরামদায়ক ফাইভস্টার হোটেলের বারান্দায় বসে সমুদ্র দেখে সময় কাটাব। কারণ আমরা সভ্য মানুষ।
.
পুনশ্চ
সমুদ্র দর্শন করে সেহেরি এবং নাজমা ভাবি ফিরেছেন। নাজমা ভাবি ভয়ানক উত্তেজিত, কারণ তিনি তার হ্যান্ডব্যাগ হারিয়ে ফেলেছেন। হ্যান্ডব্যাগে পাসপোর্ট এবং ডলার। নাজমা ভাবিকে মনে হচ্ছে এক্ষুণি তার হার্ট অ্যাটাক হবে।
আমি বললাম, আপনারা কি হোটেলের রেস্টুরেন্টে চা-নাস্তা খেয়েছেন? সেখানে ব্যাগ ফেলে আসতে পারেন। নাজমা ভাবি উল্কার মতো রেস্টুরেন্টের দিকে ছুটে গেলেন।
সেহেরি হাসিমুখে বলল, খুঁজে মরুক। একটা শিক্ষা হোক।
শাওন বলল, বিদেশে পার্সপোর্ট, ডলার হারানো তো ভয়ংকর ব্যাপার। সেহেরি ভাই, আপনি এত নিশ্চিন্ত কেন?
সেহেরি মুচকি হেসে বলল, ব্যাগ আমি লুকিয়ে রেখেছি। উচিত শিক্ষা।
অনুরাধাপুর মৃত নগরী
০৮.
আমরা অনুরাধাপুর মৃত নগরীর গেটে দাঁড়িয়ে আছি। শাওনকে অত্যন্ত বিব্রত এবং লজ্জিত দেখাচ্ছে। সে যতটা বিব্রত, নাজমা ভাবি ততটাই আনন্দিত। ঘটনা হলো–
অনুরাধাপুর মৃত নগরীতে ঢুকতে চড়া দামে টিকিট কাটতে হয়। সার্কদেশের নাগরিকরা পাসপোর্টে দেখালে অর্ধেক দামে টিকিট পায়। শাওন আমাদের পাসপোর্ট আনতে ভুলে গেছে। নাজমা ভাবি তার এবং সেহেরির পাসপোর্ট এনেছেন। তারা অর্ধেক দামে টিকিট কাটতে পারবেন। আমাদের দিতে হবে ডাবল দাম।
নাজমা ভাবি আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে নিজের মনে গজগজ করছেন, দেশ বিদেশ ঘুরলেই হয় না। নিয়মকানুন জানা লাগে। বিদেশের মাটিতে পাসপোর্টে হলো কলিজার মতো। কলিজা সবসময় সঙ্গে থাকা লাগে। কলিজা হোটেলে ফেলে আসতে হয় না।
ড্রাইভার দিগায়ু অনেক চেষ্টা করল সার্ক টিকিটে আমাদের ঢোকাতে। শেষমেষ সন্দেহজনক চেহারার একজনকে নিয়ে এল। সে গলা নামিয়ে বলল, বিনা টিকিটেই সে সবাইকে ঢুকিয়ে দেবে। বিনিময়ে সে সার্ক দেশের হিসেবে টাকা নেবে।
সেহেরি আনন্দিত গলায় বলল, প্রবলেম সলভড। আমরা তোমাকে এখন টাকা দেব না। সব দেখা শেষ হওয়ার পর টাকা পাবে।
ঐ লোক বলল, অসুবিধা নেই।
আমি অবাক হয়ে মেহেদিরঙে রাঙানো ধবধবে সাদা দাড়ির সুফি সাধকদের চেহারার সেহেরির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি বললাম, সেহেরি, এই লোক ঘুষ খেতে চাচ্ছে। আমি তাকে ঘুষ দেব?
সেহেরি বলল, যে টাকাটা আমরা খরচ করতাম, সেই টাকাই তো তাকে দিচ্ছি। আমাদের দিক থেকে আমরা ক্লিয়ার। আমি শাওনের দিকে তাকালাম, সে কিছু বলছে না। এর অর্থ সেহেরির যুক্তি সে মেনে নিচ্ছে। আমি বললাম, টাকা বাঁচানোর জন্যে ভুল যুক্তিতে আমি যাব না। লোকটা তার দেশকে ফাঁকি দিতে চাচ্ছে, সেই সুযোগ তাকে দেব না। আমি একজন লেখক। একজন লেখক কখনো এ ধরনের কাজ করেন না।
টিকিট কাটা হলো। আমি একজন গাইড নিলাম। তাকে দু’হাজার টাকা দিতে হবে। সে মৃত নগরীর সব বিষয় আমাদের বোঝাবে। গাইড কতটুকু জানে তা বোঝার জন্যে আমি বললাম, সংঘমিত্রা কে?
গাইড বলল, ভারত সম্রাট অশোকের একমাত্র মেয়ে। তিনি অনুরাধাপুর এসেছিলেন।
মহেন্দ্র কে?
ইনি সম্রাট অশোকের একমাত্র পুত্র। বৌদ্ধধর্ম প্রচারের জন্যে ইনিও অনুরাধাপুর এসেছিলেন।
বোঝা গেল গাইড ভালোই জানে। আমি বললাম, তুমি নিজ থেকে বকবক করবে না। তোমাকে আমরা কেউ যখন কিছু জিজ্ঞেস করব তখনই জবাব দেবে।
গাইড না-সূচক মাথা নাড়ল, এর অর্থ হ্যাঁ।
বিসুভিয়াস আগ্নেয়গিরির লাভায় ঢাকা পড়ে সমৃদ্ধশালী পম্পেই নগরী মৃত নগরীতে পরিণত হয়েছিল। অনুরাধাপুর মৃত নগরী হয়েছে কালের লাভায় চাপা পড়ে।
অসংখ্য টুরিস্ট বিস্ময় নিয়ে মৃত নগরী দেখছে। সব দলের সঙ্গেই একজন গাইড। গাইডরা মুখস্থ পড়া বলার মতো করে অনুরাধাপুরের ইতিহাস বলছে।
আমি ট্যুরিস্টদের তিন ভাগ করে ফেললাম–
১. এদের হাতে ভিডিও ক্যামেরা। তারা যা দেখছে, ভিডিও ক্যামেরায় তুলে ফেলছে। ভিডিও ক্যামেরা মাঝে মাঝে ধরছে গাইডের মুখে। এই দলে জাপানি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বেশি। ওদের নিজেদের ভিডিও করার আগ্রহ নেই বললেই হয়।
২. এদের হাতে ছোট স্টিল ক্যামেরা। এরাও যা দেখছে তার ছবি তুলছে। নিজেরা দর্শনীয় জায়গার সামনে দাঁড়িয়ে ছবির জন্যে পোজ দিচ্ছে। বেশির ভাগই ইউরোপের। মধ্যবয়স্ক এবং বৃদ্ধ বৃদ্ধা।
৩. তৃতীয় দলের হাতে কোনো ক্যামেরা নেই। বয়স অল্প। এরা ক্যামেরার চোখ দিয়ে কিছু দেখছে না। এরা এসেছে জোড়ায় জোড়ায়। হাঁটছে একজন আরেকজনের কোমর জড়িয়ে। বেশির ভাগ আমেরিকান। বয়স অল্প। গাইডের কথার প্রতি এদের কোনো মনোযোগ নেই। এদের কাছাকাছি গেলে তীব্র গাঁজার গন্ধ পাওয়া যায়।
আমি দলবল নিয়ে একটা প্রাসাদের পর আরেকটা প্রাসাদে যাচ্ছি। কী বিপুল ঐশ্বর্য এবং সৌন্দর্য নিয়ে এইসব প্রাসাদ দাঁড়িয়ে ছিল। আজ ধ্বংসস্তূপ।
পুত্র নিষাদ অবাক হয়ে বলল, বাবা! আমরা ভাঙাবাড়ি দেখছি কেন?
নাজমা ভাবি সঙ্গে সঙ্গে বললেন, হুমায়ুন ভাইয়ের এই ছেলেটা ট্যালেন্ট। ঠিকই বুঝেছে ভাঙা ঘরবাড়ি দেখার কিছু নাই। এখন পর্যন্ত হাতি দেখলাম না। ভাঙা দালানকোঠার মধ্যে ঘুরছি। সাপে কাটে কি না কে জানে! ভাঙা দালানকোঠা সাপের আখড়া। ডলার খরচ করে এসে সাপের কামড় খাওয়ার কোনো মানে হয়?