কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত এই বিজয় সিংহকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতার প্রথম দু’টি চরণ–
“আমাদের ছেলে বিজয় সিংহ হেলায় লংকা করিয়া জয়
সিংহল নামে রেখে গেছে তার শৌর্যের পরিচয়।”
কবিতার দুটি চরণ আমাকে দিয়েছেন সাংবাদিক বন্ধু সালেহ চৌধুরী। তিনি যে-কোনো কবিতা একবার পড়লে বাকি জীবন মনে রাখতে পারেন, তবে নিকট মানুষজনের নাম মনে রাখতে পারেন না। তার নাতি-নাতনিদের কার কী নাম এই নিয়ে মাঝে মাঝেই তাকে বিভ্রান্ত হতে দেখা যায়
বিজয় সিংহ বিষয়ে একটি কুৎসিত জনশ্রুতি আমাকে বললেন আর্কিটেক্ট নাট্যকার ও নির্মাতা শাকুর মজিদ। তিনি বললেন, বিজয় সিংহের কোনো পিতা নেই। তার পিতা হলো মা শচিদেবীর পোষা সিংহ। মানুষ এবং সিংহের মিলনে বিজয় সিংহের জন্ম হয়। যে কারণে তার আচার-আচরণ ছিল সিংহের মতো।
এরকম কোনো তথ্য আমি পাই নি। বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে আমি জেনেছি, বিজয় সিংহ তার দলবল নিয়ে অর্ধমৃত অবস্থায় শ্রীলংকায় পৌঁছেন। নারকেল খেয়ে কোনোরকমে তাদের জীবন রক্ষা হয়।
বিজয় সিংহ সিংহের মতো কোনো সাহসও দেখান নি। স্থানীয় নৃপতিকে দলবলসহ নিমন্ত্রণ করে কাপুরুষের মতো সবাইকে হত্যা করেছেন।
.
প্রাচীন শ্রীলংকা রাবণের দেশ বলে আমরা জানি। রাবণ রামপত্নী সীতাকে হরণ করেছিলেন। অনেক ঝামেলা করে লংকায় অগ্নিকাণ্ড করে সীতাকে উদ্ধার করা হয়।
আসলেই কি এমন কিছু ঘটেছিল? নাকি পুরোটাই গল্পগাথা? বলা কঠিন। শ্রীলংকার লিখিত ইতিহাস শুরু হয় বিজয় সিংহ থেকে। তার আগের ঘটনা মানুষের কল্পনা, জনশ্রুতি, মিথ এবং গল্পগাথা।
পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়ণের আমার জীবনযাত্রা বই থেকে উদ্ধৃত করছি–
সকালবেলা আমরা সীতা এলিয়া দেখতে গেলাম। লংকা যখন রাবণের দ্বীপ তখন তার রাজধানী আর হরণ করে আনা সীতাকে রাখার একটা স্থান নিশ্চয়ই থাকবে। বাবু মথুরাপ্রাসাদ স্থানটির নির্জনতা আর রমণীয়তা–পাশে বয়ে যাওয়া স্বচ্ছতায়া ছোট নদী আর পাহাড়ের গায়ে ফুলে লাল অশোক গাছগুলো দেখে বললেন, ‘ঠিক, এটাই মহারানী জানকীর অশোকবন।’ বড় শ্রদ্ধাভরে তিনি অশোকের পাতা নিজের কাছে রাখলেন। আমি পাশের পাহাড়ের ঘাসের নিচে দেড় দু’ফুট মোটা কালো মাটি দেখিয়ে বললাম, ‘আর এই দেখুন সোনার লংকার দহন’।
লংকা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করায় আমি বললাম, ‘রাবণের কাহিনীর সত্যতা ব্যাপারে আমি দিব্যি গালতে রাজি নই।
তবে যদি কিছু থেকে থাকে, তো এই’।
সীতাকে সত্যি যদি অপহরণ করে লংকায় আনা হয় তাহলে তার নামে কিছু জায়গার নাম লংকায় থাকার কথা। তা কিন্তু আছে। যেমন, সীতা টালাওয়া (সীতাভূমি), সীতাএলা (সীতার নদী, রাহুল সাংস্কৃত্যায়ন এই জায়গায় এসেছিলেন।), সীতাকুণ্ড (সীতার দিঘি)।
বাল্মীকির রামায়ণ এবং কল্পপুরাণ দুটি গ্রন্থই শ্রীলংকাকে বিশাল মহাদেশ বলে উল্লেখ করেছে, তা কিন্তু না। এই দুই গ্রন্থের সঙ্গে শ্রীলংকার আয়তন মেলানো যায় না। তবে বলা হয়ে থাকে শ্রীলংকার বড় অংশই সমুদ্রে তলিয়ে গেছে। আগে মালদ্বীপও শ্রীলংকার সঙ্গে যুক্ত ছিল।
রাবণ-সীতার রহস্য কোনো একদিন দূর হয়ে যাবে এই আশায় রইলাম।
ইতিহাস চিন্তায় বিঘ্ন ঘটল। নিনিত জেগে উঠেছে। সে দুধ খাবে। একই সঙ্গে তার কান্না থামানো এবং তার জন্য দুধ বানানো দুরূহ কর্ম। ফিনল্যান্ডের মহিলা এগিয়ে এলেন। আমি তার কোলে নিনিতকে দিয়ে নিনিতের জন্যে দুধ বানাতে বানাতে বললাম, তুমি আমার বাচ্চাটির এত ছবি তুললে। এখন তার কান্না সামলাচ্ছ। একবারও তো জিজ্ঞেস করলে না, বাচ্চাটির নাম কী?
মহিলা বিব্রত গলায় বললেন এর নাম কী?
আমি বললাম, এর নাম নিনিত। নামের অর্থ Grace of God.
অবাক হয়ে দেখলাম মহিলাটির মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে গেল। সে বিড়বিড় করে বলল, এর নাম নিনিত?
আমি বললাম, হ্যাঁ। ততক্ষণ নিনিতের মুখে দুধের ফিডার দেওয়া হয়েছে। সে কান্না থামিয়েছে। ফিনল্যান্ডের মহিলা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছেন।
এমন কি হতে পারে যে তার নাতিটির নামও নিনিত! রহস্যময় প্রকৃতি মানুষকে নিয়ে নানান খেলা খেলে। এখানেও কোনো খেলা খেলছে!
আমি মহিলাকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। সব রহস্য ভাঙতে হয় না।
.
পুনশ্চ-১
শাওন গুরুগৃহ দর্শন করে ফিরেছে। তার চোখমুখ আনন্দে উজ্জ্বল। জেফরি বাওয়া যে চামড়ার চেয়ারে বসতেন, সেখানে সে নিষাদকে বসিয়ে ছবি তুলেছে। লাইব্রেরি থেকে জেফরি বাওয়ার একগাদা বই কিনেছে। সে হাত নেড়ে নেড়ে বসতবাড়িটা কতটা যে সুন্দর এবং কেন সুন্দর তা বুঝানোর চেষ্টা করছে।
আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছি এরকম অভিনয় করলাম। একবার ভাবলাম শাওনকে বলি, তোমার এই গুরু কিন্তু চিরকুমার এবং সমকামী। তারপর ভাবলাম দরকার কী এই প্রসঙ্গের! কথায় আছে–
“যদ্যপি আমার গুরু বেশ্যাবাড়ি যায়
তদ্যপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়।”
গুরু বলে কথা।
.
পুনশ্চ-২
জেফরি বাওয়া
কলম্বো শহরে ১৯১৯ সনে জন্মগ্রহণ করেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেন (১৯৩৮-১৯৪১)। লন্ডনে আইন পড়েন, ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরেন। আইন ব্যবসা শুরু করেন। হাতে কিছু টাকাপয়সা আসতেই লুনুগঙ্গায় তিনি পরিত্যক্ত একটি রাবার বাগান কিনে নেন। রাবার বাগানে ঘরবাড়ি তুলতে থাকেন নিজের মতো করে। এই হলো তার আর্কিটেক্ট জীবনের শুরু। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, স্থাপত্যবিদ্যায় তাঁর কোনো পুঁথিগত পড়াশোনা নেই।