আমরা বেনটোটায় এসেছি। হোটেলের নাম সেরেনডিপ। বলাই বাহুল্য, এই হোটেলের ডিজাইনও জেফরি বাওয়া করেছেন। সব সফরের থিম থাকে। আমাদের সফরের থিম হচ্ছে ‘জেফরি বাওয়া’।
খুব কাছেই জেফরি বাওয়ার বসতবাড়ি। এটা এখন মিউজিয়াম। দর্শকরা টিকিট কেটে মিউজিয়াম দেখবেন, ছবি তুলবেন। জেফরি বাওয়া নব্বই বছর বয়সে দু’হাজার তিন সালে মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি এই বাড়িতেই থাকতেন। দর্শনার্থীরা তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে পারত। তাঁর বইয়ে অটোগ্রাফ নিতে পারত।
তিনি নেই কিন্তু তার বসতবাড়িতে দর্শনার্থীদের ভিড় কমে নি, বরং বেড়েছে। শাওন ক্যামেরা নিয়ে তার ভাবগুরুর বাড়ি দেখতে গিয়েছে। সঙ্গে পুত্র নিষাদ। আমি ছোটটিকে নিয়ে সমুদ্রতীরে বসে আছি।
পাঠকদের অনেকেই হয়তো জানেন, পৃথিবীতে দু’ধরনের সমুদ্র সৈকত আছে। একটা সাধারণ–যেমন, কক্সবাজার সৈকত। অন্যটির নাম সোনালি সৈকত (Golden beach), যার বালি সোনালি।
আমরা সোনালি সৈকতে আছি। আমাদের উপর নারকেল গাছের সারি। প্রতিটি ডাব বা নারকেলের বর্ণ তামার মতো। সোনালি সৈকতের সঙ্গে এই তামা রঙ চমৎকার মানিয়েছে।
আমাদের সঙ্গে প্রচুর সাদা চামড়ার টুরিস্ট। মেয়েগুলোর গায়ে বিকিনি। এরা সূর্যস্নান করছে।
আমি এবং পুত্র নিনিত করছি ছায়াস্নান। আমরা বসে আছি নারকেল গাছের ছায়ায়। পুত্র নিনিত জেগেছে। খুব হাত-পা নাড়ছে। তার সঙ্গে কিছুক্ষণ একতরফা গল্প করলাম। যেমন
আমি : সমুদ্র কেমন লাগছে বাবা?
নিনিতঃ পা দিয়ে ঝাঁকি। অর্থ সম্ভবত আমি তো সমুদ্রে নামি নি। কী করে বলব!
আমি : গায়ে রোদ চিড়বিড় করছে না তো?
নিনিত : কুঁ ওয়া।
আমি : ছায়াতে বসে মজা পাচ্ছ?
নিনিত : অয়
[সিলেটি ভাষায় বলল, হ্যাঁ। বেশিরভাগ সময় সে চাইনিজদের মতো কিচমিচ শব্দ করে। এই প্রথম সিলেটি ভাষা।]
আমাদের কথাবার্তায় সাদা চামড়ার এক বুড়ি ক্যামেরা হাতে এগিয়ে এল। এই বুড়ির গায়েও বিকিনি। থলথলে শরীরে বিকিনি যে কী কুৎসিত দেখায় তা মনে হয় এই বুড়িকে কেউ বলে নি।
বুড়ি বিনয়ের সঙ্গে বলল, আমি কি এই শিশুটির একটি ছবি তুলতে পারি?
বেশিরভাগ পিতা-মাতাই বলত, অবশ্যই তুলতে পারো। আমি বললাম, ছবি তুলতে চাচ্ছ কেন?
বুড়ি বলল, আমার বড় ছেলের একটি ছেলে হয়েছে, দেখতে অবিকল এই শিশুটির মতো। আমি এই গল্পটা তাকে বললে সে বিশ্বাস করবে না। ছবি দেখালে বিশ্বাস করবে।
ছবি তোলো।
ছবি তোলা হলো। একটি ছবি আমাকে তুলতে হলো। সেখানে বুড়ি নিনিতকে কোলে নিয়ে নকল হাসি হাসল।
আমি বললাম, শ্রীলংকা কেমন লাগছে?
বুড়ি বলল, আমি তো শ্রীলংকা দেখতে আসি নি। আমি এখানকার রোদ গায়ে মাখতে এসেছি। আমার দেশ ফিনল্যান্ডে। সেখানকার তাপ এখন শূন্যের ৩০ ডিগ্রি নিচে।
আমি বললাম, তোমার দেশ ফিনল্যান্ড আমি বেড়াতে গিয়েছিলাম। সুইডেন থেকে জাহাজে করে।
বুড়ি অবাক হয়ে বলল, ফিনল্যান্ড কেন গিয়েছিলে?
আমার স্ত্রী এবং পুত্রকে বরফের দেশ দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। তুমি যেমন রোদ দেখে আনন্দে আত্মহারা, তারাও বরফ দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়েছিল।
বুড়ি বলল, তুমি কী করো জানতে পারি।
আমি বললাম, আমি কিছুই করি না। আমাকে বেকার বলা যেতে পারে।
বুড়ি : তুমি কোনো কাজ করো না?
আমি : না।
বুড়ি নিজের জায়গায় ফিরে হাত-পা রোদে মেলে সিগারেট ফুঁকতে শুরু করেছে। আমি পুত্রের সঙ্গে কথোপকথনে মন দিয়েছি। আমি যা-ই বলছি সে তার উত্তরে কুঁ জাতীয় শব্দ করছে। সে এই মুহূর্তে কী ভাবছে, চারপাশের জগতটা তার কেমন লাগছে যদি জানা যেত!
সেহেরি এসে বলল আমার পাশে। তার হাতে আমের জুস (এই দ্বীপে সারা বছর আম হয়।) সেহেরির চোখমুখ উজ্জ্বল। আমি বললাম, ভাবি কোথায়?
সেহেরির মুখ আরও হাসি হাসি হয়ে গেল। সে বলল, নাজমা গেছে স্যুটকেসের তালা কিনতে।
আমি বললাম, তোমাকে খুব আনন্দিত দেখাচ্ছে। তালা কেনার সঙ্গে তোমার আনন্দের সম্পর্ক কী?
সেহেরি বলল, সে প্রতিটি দোকানে ঢুকবে। দোকানের সব তালা পরীক্ষা করবে। শেষে কিনবে না। আবারও প্রথম দোকান থেকে তালা দেখা শুরু করবে। দুপুরে খাওয়ার আগে সে ফিরবে না। আমি এইজন্যেই আনন্দিত।
সেহেরি লম্বা সৈকত চেয়ারে শুয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই নাক ডাকিয়ে ঘুমুতে শুরু করল। সে ঘুমাচ্ছে; তার পাশে গ্লাসভর্তি আমের জুস। সেখানে মাছি ভনভন করছে। সেহেরির নাক ডাকার শব্দে তারা খানিকটা বিভ্রান্ত। সেহেরির নাক ডাকা মাঝে মাঝে সমে এসে হঠাৎ নতুন উদ্যমে বিকট শব্দে শুরু হয়। তখন মাছির ঝাঁক পালিয়ে যায়। সেহেরি একটু ঠান্ডা হলে ভয়ে ভয়ে ফিরে আসে। দৃশ্যটা দেখতে ভালো লাগছে।
আমার হাতে বই। বইটার নাম Outlines of Ceylon History, বইটি প্রকাশিত হয় ১৯১১ সালে। লেখকের নাম Donald Obeyesekere. যথেষ্টই আনন্দ নিয়ে বইটি পড়ছি। এই বই পড়েই জানলাম কবি মিল্টন শ্রীলংকা নিয়ে একটি কবিতা লিখেছেন–
Embassies from regions far remote,
From India and the golden chersonese,
And from utmost India iste, Taprobane.
এখানে laprobane হলো শ্রীলংকা। শ্রীলংকার আদি নাম Taprobane.
শ্রীলংকায় প্রথম বসতি স্থাপন করেন Wijeya (বিজয়)। তিনি তার দলবল নিয়ে কোত্থেকে এসেছিলেন শুনলে পাঠক চমকে উঠবেন। তিনি এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকে (Bengal). তার মা’র নাম শচিদেবী। শচিদেবী সেই সময়কার বাংলার রাজার বড় মেয়ে।