আমার পাথর সংগ্রহের নেশা যখন তুঙ্গে তখন দুটি দেশে খুব যেতে ইচ্ছা করত–একটি শ্রীলংকা, অন্যটি বার্মা। বার্মায় পাওয়া যায় খাঁটি রুবি। রুবি, নীলা এবং পদ্মরাগ মণির মতোই দামি। দুটি দেশের কোনোটাইতেই যাওয়া হয় নি। কারণ বার্মায় সামরিক জান্তা। আসল মগের মুল্লুক। আর শ্রীলংকায় চলছে গৃহযুদ্ধ।
দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, শ্রীলংকায় যখন এসেছি তখন আমার রত্ন সংগ্রহু রোগ সেরে গেছে। অল্প বয়সে ছেলেমেয়েরা স্ট্যাম্প কালেক্ট করে খাতা ভরিয়ে ফেলে। একসময় তাদের এই ব্যাধি সেরে যায়। খাতাও হারিয়ে যায়। কয়েন কালেক্টারদের একই অবস্থা। অনেক ঝামেলা করে সংগ্রহ করা মুদ্রা একসময় যেখানে সেখানে পড়ে থাকে।
আমি রত্ন সংগ্রহ করছি ত্রিশ বছর ধরে। সবই বাক্সবন্দি। কাউকে মুগ্ধ এবং বিস্মিত করতে চাইলে বাক্স খুলি।
আজ আমি শ্রীলংকার রাস্তায়। কিছুদূর পরপরই Gems-এর দোকান। একবারও দোকানে ঢুকতে ইচ্ছা করল না।
শাওন বলল, রত্নের দেশে এসে রত্ন কিনবে না?
আমি বললাম,’ আনা রাজুলুন মিসকিন।’
শাওন বলল, এর মানে কী?
আমি বললাম, এর অর্থ আমি একজন মিসকিন। মিসকিনের রত্নরোগ সাজে না। কাজেই রত্ন কেনা হবে না।
শাওন বলল, আমি টাকা দিচ্ছি। তুমি তোমার পছন্দের একটা রত্ন কিনে আনো।
আমি রত্নের দোকানে ঢুকলাম না। কাঠের মূর্তির দোকানে ঢুকে একটি বুদ্ধ মূর্তি কিনলাম।
নাজমা ভাবি মহা রিক্ত হলেন। ভুরু কুঁচকে বললেন, এত দাম দিয়ে বুদ্ধের মূর্তি কিনেছেন। আপনি কি বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করবেন?
আমি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লাম। শ্রীলংকায় হাঁ-সূচক মাথা নাড়ার অর্থ না। ভাবি তা বুঝলেন না। তিনি স্বামীর কাছে নালিশ করলেন, হুমায়ূন ভাই বৌদ্ধ ধর্ম নিবেন। ছিঃ ছিঃ কী কাণ্ড। লেখক হলেই যা ইচ্ছা তা করা যায়?
আমি নাজমা ভাবির সঙ্গে ঝামেলায় গেলাম না, গৌতম বুদ্ধের মতো মৌনভাব ধারণ করলাম।
রাতে ঘুমাতে যাব হঠাৎ দেখি আমার বালিশের উপর চমৎকার একটি মুন স্টোন। চন্দ্রের আলোর মতো হালকা আলো বের হচ্ছে। মুন স্টোনের সঙ্গে একটি চিঠি। শাওন লিখেছে–
“তুমি বদলে যাচ্ছ কেন?
একসময় পাগলের মতো gems খুঁজে বেড়াতে। আজ ফিরেও তাকাচ্ছ না। বদলে যাওয়া হুমায়ুন আহমেদ আমি দেখতে চাই না। আমি চাই তুমি কখনো বদলাবে না।”
আমি শাওনকে বললাম, চলো দুজন হাত ধরাধরি করে সমুদ্রের পাশ থেকে ঘুরে আসি।
শাওন বলল, নিষাদ নিনিত?
ওরা ঘুমাচ্ছে। নাজমা ভাবিকে বলো ওদের দিকে নজর রাখতে। বেশিক্ষণ তো আর বাইরে থাকব না। বেশি হলে পনেরো মিনিট।
নাজমা ভাবি সব শুনে বললেন, পুলাপানের ক্যাঁও ম্যাঁও আমার ভালো লাগে না। এরা দুজন একসঙ্গে কাঁদে। আমি পারব না।
বলেই তিনি নিজের ঘরে ঢুকে বেশ শব্দ করে দরজা বন্ধ করলেন।
শাওন বলল, প্রথম রাতে গান শুনতে চেয়েছিলে। এখন কি গাইব?
আমি বললাম, হ্যাঁ।
শাওন গাইছে। আমি দুই পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে তার গান শুনছি
“মুখপানে চেয়ে দেখি, ভয় হয় মনে
ফিরেছ কি ফির নাই, বুঝিব কেমনে।”
.
পুনশ্চ
শ্রীলংকার সবচেয়ে সুন্দর বুদ্ধমূর্তির নাম ‘আউকানা’। তের মিটার উঁচু গৌতম বুদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন। এই নামের অর্থ সূর্যখাদক (Devourer of the Sun.), অনুরাধাপুরের নৃপতি ধাতুসেনার নির্দেশে এটি বানানো হয়। এই মূর্তিটি সবচেয়ে সুন্দর দেখায় সূর্যোদয়ের মুহূর্তে।
বুদ্ধের মূর্তির বসার ভঙ্গি এবং হাতের মুদ্রার অর্থ আছে। এ থেকে বলে দেওয়া যায় তিনি জেগে আছেন না সমাধিতে চলে গেছেন। আমার কাঠের কেনা মূর্তিটির ভঙ্গি জাগ্রত।
মূর্তিবিষয়ক শেষ কথাটা বলি। পুত্র নিষাদ দেশে ফিরে সবাইকে বলছে, আমরা শ্রীলংকার আল্লাকে কিনে এনেছি।
শ্রীলংকান তামিল ছাত্র
০৫.
নর্থ ডেকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে Ph.D, করতে গিয়ে একজন শ্রীলংকান তামিল ছাত্রের সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। সেও Ph.D. করতে এসেছে। তার নাম রত্ন সভাপতি সুরিয়া কুমারণ। আমেরিকানরা এই নাম ছোট করে ডাকে সুরি। আমিও ডাকি সুরি।
সুরি অতি ভদ্ৰ অতি লাজুক ছেলে। ভাত না খেলে তার পেট ভরে না বলে আমার এখানে মাঝে মাঝে ভাত খেতে আসে।
আমি তাকে বললাম, বিয়ে করে বউ নিয়ে আসো। প্রবাস জীবন তখন সহনীয় হবে। সে বলল, আমার পক্ষে বিয়ে করা এখন কঠিন। আমার বাবা-মা দরিদ্র। বিয়ে করলে তাদের ছেড়ে আমাকে শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে হবে। আমার রোজগারের টাকা শ্বশুর-শাশুড়ির হাতে তুলে দিতে হবে।
আমি বললাম, সব ছেলেকেই কি বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি চলে যেতে হয়।
সুরি বলল, হ্যাঁ। এটাই আমাদের দেশের নিয়ম।
আমি বললাম, বাংলাদেশেও যে কিছু ছেলে বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে উঠে না, তা-না। তাদেরকে বলা হয় ঘরজামাই। ঘরজামাইদের আমরা ছোট চোখে দেখি। তাদেরকে অমেরুদণ্ডী প্রাণী ভাবা হয়।
শ্রীলংকার অনেক পারিবারিক গল্প আমি সুরির কাছে শুনেছি। এখন মনে পড়ছে না।
আমেরিকার প্রবাস জীবনে আমি একটা উপন্যাস শুরু করি। উপন্যাসটি প্রকাশ করি দেশে ফিরে। নাম– সবাই গেছে বনে। এই উপন্যাসটি উৎসর্গ করা হয় রত্ন সভাপতি সুরিয়া কুমারণের নামে।
শ্রীলংকায় যাওয়ার পর থেকেই আমার এই বন্ধুটির কথা মনে পড়ছিল। শাওনকে বলতেই সে ইন্টারনেট খুলে বসে গেল। ফেসবুক থেকে বের করে ফেলবে। বের করতে পারল না।