- বইয়ের নামঃ রাবণের দেশে আমি এবং আমরা
- লেখকের নামঃ হুমায়ূন আহমেদ
- প্রকাশনাঃ অন্যপ্রকাশ
- বিভাগসমূহঃ জীবনী, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী
সিল্কের ঝলমলে লুঙ্গি
রাবণের দেশে আমি এবং আমরা — ভ্রমণকাহিনী — হুমায়ূন আহমেদ
ভূমিকা
এই বইটিকে ভ্রমণকাহিনী বলা যাবে না। ভ্রমণকাহিনী আমি আসলে লিখতে পারি না। বিদেশে ট্রাভেলগ নামে কিছু বই আছে। ভ্রমণের সঙ্গে গল্প মেশান। এই বইটিকে ট্রাভেলগও বলা যাবে না। ভিন দেশে আমাদের আনন্দ-বেদনার কাব্য বলা যেতে পারে। চেষ্টা করেছি তথ্য দিয়ে বইটিকে ভারী না করতে, বাধ্য হয়ে কিছু তথ্য দিতে হয়েছে। তথ্যে ভুল থাকার কথা না, তারপরেও কোনো ভুল কারও চোখে পড়লে আমাকে জানাবেন। পরের সংস্করণে ঠিক করে দেওয়া হবে।
শ্রীলংকা দেখার আমার শখ ছিল। কারণটা বিচিত্র। মহান বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর লেখক আর্থার সি ক্লার্ক নিজ দেশ ফেলে সারা জীবন এই দেশে কাটিয়েছেন। একজন লেখকের কাছে নিজ দেশের চেয়ে অন্যদেশ কেন মনে ধরল তা জানার ইচ্ছা ছিল।
হুমায়ূন আহমেদ
নুহাশপল্লী
.
০১.
সিল্কের ঝলমলে লুঙ্গি পরা একজন হাস্যমুখী মানুষ। দেখতে আমাদের বাঙালিদের মতো। যখনই হাসছেন তখনই ধবধবে সাদা দাঁত ঝকমকিয়ে উঠছে। ভদ্রলোকের হাতে গোলাপি রঙের ক্যামেরা। তিনি বিপুল উৎসাহে ক্যামেরায় একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছেন। মাঝে মাঝে নিজেও ছবির জন্যে পোজ দিচ্ছেন। তাঁর ক্যামেরায় অন্যরা ছবি তুলে যাচ্ছে।
ঘটনাটা ঘটছে ঢাকা এয়ারপোর্টের (এই এয়ারপোর্টের নাম ঘনঘন বদলাচ্ছে বলে ঢাকা এয়ারপোর্ট বলছি) যাত্রীদের ওয়েটিং লাউঞ্জে, যেখানে শ্রীলংকাগামী যাত্রীরা প্লেনে ওঠার অপেক্ষায় বসে আছেন। যাত্রীদের মধ্যে আছি আমি, দুই পুত্র এবং তাদের মা শাওন। লুঙ্গি পরা মানুষটির কর্মকাণ্ড আগ্রহ নিয়ে দেখছি। আগ্রহে বাধা পড়ল, কারণ হঠাৎ করেই পারিবারিক বিপ্লবের সূচনা হলো। তিন মাস বয়েসী কনিষ্ঠপুত্র নিনিত গলায় মাইক ফিট করে কান্না শুরু করেছে। সে দুধ খাবে। কৌটার দুধ আছে, কিন্তু তার মা দুধ গোলানোর পানি আনতে ভুলে গেছে। বেচারিকে বিব্রত দেখাচ্ছে।
নিনিতের বড় ভাই নিষাদের বয়স সাড়ে তিন বছর। সে তার ছোট ভাইকে কাঁদতে দেখলেই নিজে কাঁদার মতো পরিস্থিতি তৈরি করে। নিষাদ বলল, আমার ক্ষিধে পেয়েছে। আমি এখন কী খাব? বলেই ভাইয়ের সঙ্গে গলা মিলিয়ে কান্না।
আমার সফরসঙ্গী স্কুলজীবনের বন্ধু সেহেরি এবং তার স্ত্রী নাজমা। তাদের মধ্যে কিছু নিয়ে ঝামেলা বেঁধেছে। নাজমা ভাবি শান্তমুখে স্বামীকে কঠিন কঠিন কথা বলছেন। সেহেরি গৌতম বুদ্ধের মতো মৌনভাব ধারণ করেছে। পারতপক্ষে সে স্ত্রীর সঙ্গে ঝামেলায় যায় না। বাইপাস অপারেশনের পর তার মধ্যে ভেজিটেবলভাব প্রবল হয়েছে। উচ্চশ্রেণীর কোনো ভেজিটেবলও না, নিম্নশ্রেণীর। যেমন ধুন্দুল।
আমাদের এই হৈচৈ ঝামেলার মধ্যে লুঙ্গি পরা মানুষটি ক্যামেরা হাতে এগিয়ে এলেন। হাসিমুখে বললেন, আমি আপনাদের ছবি তুলি?
আমি যথেষ্টই বিরক্ত হয়ে ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। তখন একজন বললেন, উনি বাংলাদেশে শ্রীলংকার হাইকমিশনার। যারা শ্রীলংকায় যাচ্ছেন তাদের হ্যালো বলতে এসেছেন।
আমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। এক জীবনে নানান দেশে গিয়েছি। কোনো দেশের হাইকমিশনার বা অ্যামবেসেডারই এয়ারপোর্টে হ্যালো বলতে আসেন নি। ঘটনাটা কী?
সেহেরি বলল, বাংলাদেশ-শ্রীলংকা সরাসরি বিমান চলাচল আজই প্রথম শুরু তো, এই কারণেই হাইকমিশনার এসেছেন।
নাজমা ভাবি যে-কোনো ঘটনা নেগেটিভ ভাবে দেখার অলৌকিক ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে এসেছেন। তিনি মহা বিরক্ত হয়ে বললেন, প্রথম বিমান চলাচল শুরু হয়েছে তার জন্যে হাইকমিশনার আসার দরকার কী? এইগুলা আবার কী ঢং! ছবি তোলাতুলিতে সময় নষ্ট। তার কারণেই তো বিমান ছাড়তে দেরি করছে।
বাংলাদেশ-শ্রীলংকা সরাসরি বিমান যাত্রার প্রথম ফ্লাইটের যাত্রী আমরা–এই তথ্য আমার জানা ছিল না। শ্রীলংকা ভ্রমণের আইডিয়া শাওনের। সব ব্যবস্থা সে করেছে। আমাকে কিছু জানায় নি, আমি জানতেও চাই নি। আমার কাছে এই মুহূর্তে শ্রীলংকা ভ্রমণ বিভীষিকার মতো। পুত্র নিনিতের বয়স তিন মাস। আমি অতীত অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বিদেশের মাটিতে পা দেওয়া মাত্র এই ছেলে তার মাকে চিনবে না। সে সারাক্ষণ বানরের বাচ্চার মতো আমার ঘাড়ে ঝুলে থাকবে। ফিডারে করে তাকে দুধ খাওয়ানো থেকে শুরু করে ডায়াপার বদলানোর সর্ব দায়িত্ব আমার। একই ব্যাপার নিষাদের বেলায়ও ঘটেছে। সারাক্ষণ বাবা! বাবা! বাবা ডাক অবশ্যই মধুর, কিন্তু বিদেশের মাটিতে না।
আমরা মিহিন লংকা বিমানে উঠেছি। সেহেরি এবং তার স্ত্রী বসেছেন আমাদের পেছনেই। নাজমা ভাবি ‘মেদভুঁড়ি কী করি’ গ্রুপের সদস্য। সিটে অনেক কষ্টে শরীর আঁটিয়েছেন। এখন বেল্ট বাঁধতে পারছেন না। তার বিরক্তি হঠাৎ তুঙ্গে উঠেছে। তিনি তার স্বামীকে ধমকাচ্ছেন–সিটে বাঁকা হয়ে বসেছ কেন? সোজা হয়ে বসো। পা নাচাচ্ছ কেন? তুমি কি পুলাপান? ওই দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছ কেন? সাদা চামড়ার মেয়ে আগে দেখো নাই? জীবনে প্রথম দেখছ?
তিন ঘণ্টার বিমান ভ্রমণে উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটল না। শুধু একজন বিমানবালা নাজমা ভাবির কাছে ধমক খেয়ে হকচকিয়ে গেল। বেচারি এসেছিল সেহেরিকে জিজ্ঞেস করতে, লাঞ্চে দুটা চয়েস আছে। নাসি গোড়াং এবং জিরা রাইস। সে কোনটা নিবে?