মাঝে শরীর খারাপ হয়েছিল এখন সেরে উঠেছি। যেতে হবে দূরে,
ঘুরতে হবে বিস্তর, ফিরতে মাসখানেক লাগবে–তার পরে কলকাতায়। তাদের একবার দেখে আসব। আমার মাটির ঘরের ভিৎ দিনে দিনে উঁচু হয়ে উঠছে।
ইতি ১ ফেব্রুয়ারী ১৯৩৫
বুড়িকে পদ্যে একটা চিঠি কিছুকাল পূর্বে লিখেছিলুম-পদ্যে সে তার জবাব দেবার চেষ্টা যেন না করে এই আমার সানুনয় অনুরোধ।
এই প্রসঙ্গে আরেকজনের উদ্ধৃতি দেবীর লোভ সামলাতে পারছি না। ইনি হচ্ছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মহান ঔপন্যাসিক আলেকজান্ডার সোলঝনিৎসিন। নিজ দেশ ছেড়ে গণতন্ত্রের স্বাধীন ভূমি আমেরিকাতে যিনি আশ্রয় নিয়েছেন। হার্বার্ড বিশ্ববিদালয়ের ৩২৭তম কমেন্সমেন্ট অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দেবার জন্যে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই বক্তৃতায় তিনি আমেরিকা এবং পাশ্চাত্য সভ্যতা প্রসঙ্গে তাঁর মোহভঙ্গের কথা অত্যন্ত জোরালো ভাষায় বলেন। পুরো বক্তৃতাটি তুলে দিতে পারলে ভালো হতো আমি অল্পকিছু অংশ তুলে দিলাম–
There are teliltale symptoms by which history gives warning to a threatened or perishing society. Such are, for instance, a decline of the arts or a lack of great statesmen. Indeed, sometimes the wamings are quite explicit and concrete. The center of your democracy and of your culture is left without electric power for a few hours only, and all of a sudden crowds of American citizens start looting and creating hovoc. The smooth surface film must be very thin, then, the social system quite unstable and unhealthy.
অধ্যাপক ক্লার্ক ব্লেইস
অধ্যাপক ক্লার্ক ব্লেইস দুপুরে তাঁর সঙ্গে খাবার জন্যে নিমন্ত্রণ করেছেন। ভারতী মুখোপাধ্যায় কেলিফোর্নিয়া থেকে ফিরে এসেছেন। এই উপলক্ষে তার সঙ্গেও দেখা হবে। ক্লার্ক এসে নিয়ে গেলেন। ভেবেছিলাম রাজপ্রাসাদের মতো বিশাল বাড়ি দেখব–তা নয়, ছোট্ট বাড়ি। ভারতী মুখোপাধায়ের সঙ্গেও দেখা হলো। শাড়ি পরা বাঙালি মেয়ে। এককালে ডাকসাইটে রূপসী ছিলেন তা বোঝা যায়। রূপের খানিকটা এখনো ধরে আছে। তিনি নিজেও একজন ঔপন্যাসিক। সাহিত্য চর্চা করেন ইংরেজি ভাষায় তাঁর লেখা একটা উপন্যাস ‘জেসমিন আমেরিকায় বেস্ট সেলার হয়েছে। অবশ্যি এই উপন্যাসে তিনি ভারতকে ছোট করে দেখিয়ে পশ্চিমের জয়গান করেছেন।
ভেবেছিলাম মন খুলে কথাবার্তা বলা যাবে–তা সম্ভব হলো না। কারণ আমার সঙ্গে নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন শ্রীলংকার কবি জেন এবং তাঁর স্ত্রী প্রতিভায় মুগ্ধ স্বামী। বলাই বাহুল্য জেন সঙ্গে করে একগাদা কবিতা নিয়ে এসেছেন এবং ক্রমাগত পড়ে যাচ্ছেন। এক সময় তিনি প্রাকৃতিক নিয়মেই ক্লান্ত হয়ে পড়লেন ভাবলাম এইবার হয়তো কথা বলার সুযোগ পাওয়া যাবে, তা পাওয়া গেল না। জেন-এর স্বামী তখন আসরে নামলেন। ছোটবেলা থেকে তাঁর যে কিছু অলৌকিক ক্ষমতা আছে সেই সব বলতে লাগলেন। জেন স্বামীকে উস্কে দিচ্ছেন–দেবীর সঙ্গে দেখা হবার গল্পটা বলো হানি। হানি, প্রিকগনিশন ড্রিমের ঐ অসাধারণ গল্পটা বলো।
ভদ্রলোক অদ্ভুত সব গল্প শোনাতে লাগলেন। বিংশ শতাব্দীতে–আমেরিকায় বসে এইসব গাঁজাখুরী গল্প শোনার কোনো মানে হয় না। কিন্তু যেহেতু আমরা সভ্য মানুষ–কান পেতে শুনে যাই। ভদ্রলোকের একটি কাহিনী হলো–দেবি স্বরস্বতীর সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাৎ। এক দুপুরে তিনি তাঁর গ্রামের রাস্তায় হাঁটছিলেন। বয়স খুবই কম-ন’-দশ। কোথাও লোকজন নেই। হাঁটতে হাঁটতে পুরোনো এক মন্দিরের কাছে চলে এলেন। মন্দিরের কাছে এসেই মিষ্টি ফুলের গন্ধে চমকে উঠলেন। তারপর দেখেন মন্দিরের ভেতর থেকে দেবী সরস্বতী বের হয়ে হাত ইশারা করে তাঁকে ডাকছেন।
আমি গল্পের এক পর্যায়ে উঠে গিয়ে অধ্যাপক ক্লার্কের ঘরের সাজসজ্জা দেখতে লাগলাম। সমস্ত ঘর ভর্তি ছোট ছোট ফ্রেম বাঁধানো প্রাচীন সব গ্রন্থের পৃষ্ঠা। ক্লার্ক বুঝিয়ে দিচ্ছেন কোনটা কি। এর মধ্যে আছে মূল শাহনামা গ্রন্থের এক পৃষ্ঠা যা তিনি তিন হাজার ডলার দিয়ে কানাডা থেকে কিনেছেন। দু’হাজার বছর আগের কোরআন শরীফের একটি পৃষ্ঠা। মোগল আমলের কিছু গ্রন্থের মলিন পাতা। সবই অতি যত্নে সংরক্ষিত।
খাবার ডাক পড়ল।
আশা করেছিলাম ভাত-ডাল-মাছ এইসব থাকবে। তা না, পিজা ডিনার। সেই পিজাও ঘরে বানানো নয়–দোকান থেকে কিনে আনা। পিজা খাচ্ছি এবং শ্রীলংকার ভদ্রলোকের অলৌকিক গল্প শুনছি। জেনের কবিতার মতো উনার গল্পও অফুরান।
প্রফেসার ক্লার্ক এক পর্যায়ে বললে, আমরা হুমায়ূনের গল্প শুনি।
আমি বললাম, আমার তো কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই কি গল্প বলব?
আমেরিকা প্রসঙ্গে অভিজ্ঞতার গল্প শুনি। ভেতর থেকে নিজেদের দেখা কঠিন। বাইরে থেকে দেখা সহজ। আমি এক বছর কোলকাতায় ছিলাম। তার ওপর ভিত্তি করে একটি বই লিখেছি–’Nights and Days and Calculta তোমাকে একটা কপি দেব। এখন তুমি বলো তুমি যে নর্থ ডেকোটায় ছিলে, কি দেখেছ? বরফ ছাড়া কি দেখেছ?
আমি নর্থ ডেকোটায় এক হাসপাতালে আমার মেজ মেয়ে শীলার জন্মের গল্পটি শুরু করলাম। তার জন্মমুহূর্তে আমাকে শীলার মার পাশে হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল। শিশু জন্মের এই ভয়াবহ ব্যাপারটাই প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে। আমি চলে গিয়েছিলাম এক ধরনের ঘোরের রাজত্বে। মনে হচ্ছিল চোখের সামনে যা দেখছি তা সত্যি নয় স্বপ্ন। স্বপ্ন ভঙ্গ হলো গুলতেকিনের কথায়, তুমি এরকম করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? বাচ্চার কান্না শুনতে পাচ্ছ না? আজান দাও। আমি বিকট শব্দে আজান শুরু করলাম। ডাক্তার এবং নার্সদের মধ্যে হৈচৈ পড়ে গেল–এই বাঙাল কি করছে?