সর্বাধুনিক একটি হাসপাতালে শিশুটির জন্ম হলো। বিশ্বের সেরা ডাক্তাররা জন্মলগ্নে শিশুটির পাশে থাকলেন। সে বাসায় ফিরল কিন্তু মায়ের কোলে ফিরল না। তার আলাদা ঘর। আলাদা খাট। কেঁদে বুক ভাসালেও মা তাকে খাবার দেবেন না। ঘড়ি ধরে খাবার দেবেন। সে বড় হতে থাকবে নিজের আলাদা ঘরে। এতে নাকি তার ব্যক্তিসত্তার বিকাশ হবে।
শিশু একটু বড় হলো। বাবা-মায়ের কাছে নয় বেশিরভাগ সময় তাকে এখন থাকতে হচ্ছে বেবি কেয়ার কিংবা বেবি সিটারদের কাছে।
তার চার-পাঁচ বছর বয়স হবা মাত্র শতকরা ৮০% ভাগ সম্ভাবনা সে দেখবে তার বাবা-মা আলাদা হয়ে গেছেন। এই ঘটনায় তারা যেন বড় রকমের শক নী পায় তার জন্যেও ব্যবস্থা করা আছে। স্কুলের পাঠ্য তালিকায় বাবা-মা আলাদা হয়ে যাবার সমস্যা উল্লেখ করা আছে।
শিশুটির বয়স বারো পার হওয়া মাত্র স্কুল থেকে তাকে জন্মনিয়ন্ত্রণের সাজসরঞ্জাম সরবরাহ করা হবে। এটি নতুন হয়েছে। যাতে যৌন রোগে আক্রান্ত না হয় সেই ব্যবস্থা। বয়োসন্ধি বয়সে যখন তারা মানসিক ও শারীরিক পরিবর্তনে হতচকিত সেই সময়টা তাদের কাটাতে হবে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর খোঁজে যাদের পরবর্তী সময়ে বিয়ে করবে। কি ভয়াবহ সেই অনুসন্ধান। একটি মেয়েকে অসংখ্য ছেলের মধ্যে ঘুরতে হবে যাতে সে পছন্দমতো কাউকে খুঁজে পায়। সময় চলে যাবার আগেই তা করতে হবে। প্রতিযোগিতা–ভয়াবহ প্রতিযোগিতা।
উনিশ-কুড়ি বছর বয়স হলো–বেরিয়ে যেতে হবে বাড়ি থেকে। এখন বাঁচতে হবে স্বাধীনভাবে। নিজের ঘর চাই। নিজের গাড়ি চাই। কোনো একটি চাকরি দ্রুত প্রয়োজন।
চাকরি পাওয়া গেল। তাতেও কোনো মানসিক শান্তি নেই। চাকরি সবই অস্থায়ী। কাজ পছন্দ হলো না তো বিদায়। সংসার প্রতিপালন করতে হচ্ছে এক ধরনের অনিশ্চয়তায়। অনিশ্চয়তায় বাস করতে করতে অনিশ্চয়তা চলে আসছে তাদের আচার-আচরণে। তাদের কোনো কিছুই একনাগাড়ে বেশিদিন ভালো লাগে না। কাজেই ইস্ট থেকে ওয়েস্ট ওয়েস্ট থেকে নর্থে। এক স্ত্রীকেও বেশি দিন ভালো লাগে না। গাড়ির মধ্যে স্ত্রী বদল হয়।
এই করতে করতে সময় ফুরিয়ে যায়। আশ্রয় হয় ওল্ড হোম। জীবনের পরিণতি। এক সময় মৃত্যুবরণ করতে হয়। মৃত্যুর পর দেখা যায় তারা তাদের ধন-সম্পদ উইল করে দিয়েছে প্রিয় বিড়ালের নামে, কিংবা প্রিয় কুকুরের নামে।
আমি আমার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় যা বুঝেছি তা হলো এদের প্রায় সবার চিন্তা-ভাবনা সীমাবদ্ধ। বস্তুকেন্দ্রিক। একটি মেয়ের জীবনের সর্বোচ্চ আকাক্ষা হলো চিয়ার লিডার হবে। ফুটবল খেলার মাঠে স্কাট উচিয়ে নাচবে। স্কাটের নিচে তার সুগঠিত পদযুগল দেখে দর্শকরা বিমোহিত হবে। এই তার সবচেয়ে বড় চাওয়া। একটি ছেলে চাইবে মিলিওনিয়ার হতে।
এই অতি সভ্য (?) দেশে আমি দেখি মেয়েদের কোনো সম্মান নেই। একজন মহিলাকে তারে দেখবে একজন উইম্যান হিসেবেই। একটি মেয়ের যে মাতৃরূপ আছে যা আমরা সব সময় দেখি ওরা তা দেখে না। একটি মেয়ে যতদিন পর্যন্ত শারীরিকভাবে আকর্ষণীয় ততদিন পর্যন্তই তার কদর।
যা কিছু হাস্যকর, তার সবই এদের ভাষায়–মেয়েলী, এফিমিনেট। শুনলে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্যি এই দেশে মেয়েরা একই যোগ্যতায় একই চাকরিতে পুরুষদের চেয়ে কম বেতন পান। বিমানের ক্যাপ্টেন যদি মহিলা হন তাহলে বিমানের যাত্রীদের তা জানানো হয় না। ক্যাপ্টেন পুরুষ হলে তবেই শুধু বলা হয়–আমি অমুক তোমাদের বিমানের ক্যাপ্টেন। মহিলা ক্যাপ্টেনের কথা বলা হয় না। কারণ মহিলা বিমানের দায়িত্বে আছেন জানলেই যাত্রীরা বেঁকে বসতে পারে। আমাদের দেশে মেয়েদের অবস্থা খারাপ তবু একজন মহিলা ডাক্তার একজন পুরুষ ডাক্তারের মতোই বেতন পান। কম পান না।
আমরা আমাদের দেশে একজন মহিলা রাষ্ট্রপ্রধানের কথা চিন্তা করতে পারি। ভাবতে পারি। ওরা তা পারে না। আসছে একশ’ বছরেও এই আমেরিকায় কোনো মহিলা প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট হবে না। অতি সুসভ্য এই দেশ তা হতে দেবে না।
জাতির শরীর যেমন আছে আত্মাও আছে। এই দেশের শরীরের গঠন চমৎকার কিন্তু আত্মা এর অত্মা কোথায়?
আজ থেকে ৭০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ আমেরিকা এসেছিলেন। নিউইয়র্ক থেকে চিঠি লিখছেন তার আদরের কন্যা মীরা দেবীকে। সেই চিঠিতে আমেরিকার ব্যাপারে তাকে উচ্ছ্বসিত হতে দেখা যায়, তার চিঠির অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করছি…
এখানে মানুষের জন্যে মানুষের চিন্তা আমাদের দেশের চেয়ে অনেক বেশি পরিমাণে উদ্বোধিত্ব। এখানে টানাটানি-কাড়াকাড়ি হট্টগোলের ভেতরও বিশ্বমানবের দর্শন পাওয়া যায়। সেই বিরাট পুরুষের দর্শনেই নিজের ব্যক্তিগত জীবনের সুখ–দুঃখের আন্দোলনকে তুচ্ছ করে দেয়। আমাদের দেশে মানুষ অত্যন্ত ছোট হয়ে আছে কেবল যে তার জীবনের ক্ষেত্র ছোট, তা নয় তার চিন্তার আকাশ সঙ্কীর্ণ…
[পত্রাবলী মীরা দেবীকে লেখা, ১৯০৬-৩৭, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সনৎ কুমার বাগচি কর্তৃক সংকলিত।]
মজার ব্যাপার হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পনের বছর পরই আমেরিকা সম্পর্কে তাঁর মত বদলান। তিনি তাঁর কন্যা মীরা দেবীকে আমেরিকা যেতে অনুৎসাহিত করে লিখেন–
কল্যাণীয়াসু,
মীরু, এখানে মেয়েদের বেশিদিন থাকার ক্ষতি আছে। তার কারণ এখানকার সমাজ সঙ্কীর্ণ এবং যারা আছে তারা অনেকেই নীচের স্তরের মানুষ। এখানে লোকের সংসৰ্গ অল্প কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হওয়াতে মানুষকে বিচার করবার আদর্শ নেবে যায় এবং লোক পরিচয়ে শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। কলকাতায় সমাজের আদর্শ এখানকার চেয়ে প্রশস্ত এবং উপরের শ্রেণীর। যেটী খেলো এবং vilgar এখানে থাকতে থাকতে সেটা সয়ে যায় এবং তার হেয়তা বুঝতেই পারিনে। অল্প বয়সে, বিশেষত মেয়েদের পক্ষে এটা অত্যন্ত মুস্কিলের। এখানে কতকগুলো বিশেষ বিশেষ বিষয়ে শিক্ষার সুবিধা আছে কিন্তু সামাজিক শিক্ষার জায়গা এটা নয়। অথচ যৌবনারম্ভে সেই শিক্ষা একান্ত আবশ্যক। বুড়িকে নিয়ে যদি তুই এখানে দীর্ঘকাল থাকিস তাহলে তাতে বুড়ির ক্ষতি হবে, এখন সে কথা বুড়ি না বুঝতে পারলেও এর পরে তা অনুতাপের কারণ ঘটতে পারে। কলকাতায় আমাদের যে সমাজ সেই সমাজের সঙ্গে বুড়িকে মিলিয়ে দিতে হবেই, নইলে সে তার নিজের ও বংশের মর্যাদা রক্ষা করতে জানবে না।