একই সঙ্গে রূপবতী এবং ভালোমেয়ে সচরাচর হয় না–তুমি অত্যন্ত ভাগ্যবান।
বুঝলে হুমায়ুন, আমার স্ত্রীর এক ধরনের ইএসপি ক্ষমতা আছে। আমি যখন লেখালেখি করি তখন সে বুঝতে পারে–কখন আমি কফি চাই, কখন খাবার চাই। ঠিক সময়ে কফি উপস্থিত হয়। ঠিক সময়ে খাবার।
বড় চমৎকার তো!
একবার সে কি করল জানো? তার সমস্ত জমানো টাকা এবং গয়না বিক্রির টাকা একত্র করে ফিলিপাইনের পাহাড়ি অঞ্চলে পাহাড়ের মাথায় ছোট্ট একটা বাড়ি কিনল। যাতে ঐ বাড়িতে বসে নিরিবিলি আমি আমার লেখার কাজ চালিয়ে যেতে পারি। আমি প্রতি বছর ঐ পাহাড়ি বাড়িতে একনাগাড়ে একা একা তিন মাস থাকতাম। নিজেই রান্না করে খেতাম সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একনাগাড়ে লিখতাম।
তোমার স্ত্রী তোমার সঙ্গে খাকত না?
ও থাকবে কি করে? ওর ঘর-সংসার আছে না? ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। ওদের কে দেখাশোনা করবে?
ঐ বাড়িটি কি এখনো আছে?
না বিক্রি করে দিয়েছি। এক সময় খুব অভাবে পড়লাম, বিক্রি করে দিলাম। এখনো ঐ বাড়ির জন্যে আমার মন কাঁদে। অনেকক্ষণ তোমার সঙ্গে গল্প করলাম। যাই এখন কাজ করি। আমি একটা জাপানি উপন্যাস টেগালগ ভাষায় অনুবাদ করছি–Snow country কাওয়াবাতার লেখা।
সিকাট টাইপ রাইটার নিয়ে বসলেন। তিনি টেগালগ ভাষায় লিখেন ঠিকই ব্যবহার করেন ইংরেজি টাইপ রাইটার। কারণ টেগালগ ভাষার নিজস্ব বর্ণমালা নেই। তাদের ভরসা রোমান হরফ। একই ব্যাপার তেহারির বেলাতেও। তিনিও নিজের ভাষাতে লেখেন ব্যবহার করেন ইংরেজি বর্ণমালা। অধিকাংশ আফ্রিকান দেশেই এই অবস্থা। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা আরো গভীর। তারা সরাসরি ইংরেজি বা ফরাসি ভাষাতেই সাহিত্য চর্চা করেন। সেনেগালের শিশু-সাহিত্যিক লিখেন ফরাসি ভাষায়, কোনো আফ্রিকান ভাষায় নয়। শ্রীলংকার কবি জেন কখনো সিংহলি বা তামিল ভাষায় লিখেননি। লিখেছেন ইংরেজিতে। নাইজেরিয়ার নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নাট্যকার ওলে সোয়েংকা (Wole Soyinka) লেখালেখি করেন ইংরেজি ভাষায়। নিজের ভাষায় না।
বাংলা ভাষার লেখক হিসেবে আমি মহাভাগ্যবান। অন্যের ভাষায় আমাকে লিখতে হচ্ছে না, অন্যের হরফ নিয়েও আমাকে লিখতে হচ্ছে না। আমার আছে প্রিয় বর্ণমালা। এই বর্ণমালা রক্ত ও ভালোবাসা দিয়ে পৃথিবীর বুকে গেঁথে দেয়া হয়েছে।
আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন স্টুডেন্ট এডভাইজার
আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন স্টুডেন্ট এডভাইজারকে এখানে ক’জন বাংলাদেশী ছাত্র আছে জানতে চেয়ে এটি চিঠি লিখেছিলাম, ফরেন স্টুডেন্ট এডভাইজার দু’দিন পরে চিঠি লিখে পাঁচজন বাংলাদেশী আন্ডার গ্রাজুয়েট ছাত্রের তালিকা পাঠিয়ে দিলেন। চিঠিতে লিখলেন–মোট ছ’জন বাংলাদেশী ছাত্র পড়াশোনা করে, তোমাকে পাঁচজনের নাম এবং টেলিফোন নাম্বার পাঠানো হলো। ষষ্ঠ জনের নাম পাঠালাম না কারণ তার ব্যক্তিগত ফাইলে লেখা আছে তার সম্পর্কে কোনো তথ্য কাউকে জানানো যাবে না।
তালিকায় সবার প্রথম যার নাম তাকেই টেলিফোন করলাম। আহসান উল্লাহ আমান। আমি বাংলা ভাষায় বললাম, আমার নাম এই, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি
সে নিখুঁত আমেরিকান উচ্চারণে ইংরেজিতে বলল, আমি বাংলায় কথা বলা ভুলে গেছি–কাজেই ইংরেজিতে বলছি।
আমি হতভম্ব! বলে কি এই ছেলে তবু পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্যে বললাম, বাংলায় কথা বলা ভুলে গিয়েছ?
ইয়েস, টোটেলি ফরগটন।
ভুলে যাওয়া বিচিত্র কিছু না বড়ই কঠিন ভাষা। আশা করি ভুলতে তোমাকে খুব কষ্ট করতে হয়নি।
অনেক দিন বাইরে আছি তো এই জন্যে ভুলে গেছি।
শুনে বড় ভালো লাগল।
আমি কি কিছু করতে পারি আপনার জন্য?।
না। তুমি কিছু করতে পারো না। ভাবছিলাম আমি তোমার জন্যে কিছু করতে পারি কি-না। মনে হচ্ছে তাও সম্ভব নয়।
আপনি কি বলছেন বুঝতে পারছি না। দয়া করে ইংরেজিতে বলুন।
অজি থাক অন্য আরেক দিন বলব।
টেলিফোন নামিয়ে হতভম্ব হয়ে বসে আছি–সিকাট এসে বললেন, তোমার কি হয়েছে?
কিছু হয় নি। কিছুক্ষণ আগে একজন বাংলাদেশী ছেলের সঙ্গে কথা হয়েছে সে বলল সে বাংলা ভাষা ভুলে গেছে।
তুমি তার ঠিকানা জোগাড় করো। তারপর আমাকে নিয়ে চলো, আমি ঘুসি দিয়ে তার নাক ফাটিয়ে দিয়ে আসব। না না ঠাট্টা না, মারামারির ব্যাপারে আমি খুব এক্সপার্ট–জার্মানিতে কি করেছিলাম তোমাকে তো বলেছি, একেবারে হৈচৈ পড়ে গেল। এম্বেসি ধরে টানাটানি।
আমি নানানভাবে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম–হয়তো এই ছেলের জন্ম হয়েছে এখানে, কোনোদিন বাংলায় কথা বলার সুযোগ হয় নি… হতেও তো পারে। বাংলাদেশের কোনো ছেলে কিছুদিন আমেরিকা বাস করে নিজের ভাষাকে অস্বীকার করবে তা হতেই পারে না।
কিংবা কে জানে হয়তো পারে। এই দেশ খুব সহজেই মানুষকে বদলে দেয়। চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করে। নয়তো কেন এত এত শিক্ষিত ভদ্রঘরের চমৎকার ছেলের বাসন মেজে দিন পার করাতেই আনন্দ এবং জীবনের পরম লক্ষ্য খুঁজে পায়। কি আছে এ দেশে সাজানো-গোছানো শহর, চমৎকার মল, চোখ ধাঁধানো হাইওয়ে? এই কি সব?
একটি আমেরিকান পরিবারের জীবনচর্যা চিন্তা করলে কষ্ট হয়। ওরা কি হারাচ্ছে তা বুঝতে পারে না। আমরা যারা বাইরে থেকে আসি–বুঝতে পারি কিংবা বোঝার চেষ্টা করি।
একটি শিশুর জন্ম থেকে শুরু করা যাক।