অপরাধ বোধ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যে নিজেই একটা ভালো কম্পাস কিনে আনলাম। সেই রাতে লেখকদের সম্মানে ফার্স্ট ন্যাশনাল ব্যাংক বিশাল এক পার্টির আয়োজন করেছে। ফরম্যাল ডিনার। খানার চেয়ে পিনার আয়োজন বেশি। অবাক হয়ে দেখি আহমদ তেহারি রেড ওয়াইন নিয়ে বসেছেন এবং বেশ তাড়িয়ে তাড়িয়ে খাচ্ছেন। আমি তার পাশে জায়গা করে বসলাম এবং মধুর স্বরে বললাম, তুমি মদপান করছ ব্যাপারটা কি?
তোহারি বললেন, মদপান দোষের নয়। মওলানা জালালুদ্দিন রুমি মদপান করতেন।
ও আচ্ছা। আমাদের প্রফেট কিন্তু করতেন না।
তোহারি আমার কথাবার্তা পছন্দ করলেন না। গ্লাস নিয়ে উঠে চলে গেলেন। আমার অপমানিত বোধ করার কথা কেন জানি তা করলাম না। বরং মজা লাগল।
আমার বাঁ পাশে বসেছেন চৈনিক ঔপন্যাসিক জংইয়ং। দেখেই মনে হয় খুব হাসি-খুশি মানুষ। কথা বলতে গিয়ে দেখলাম তার ইংরেজি জ্ঞান ‘ইয়েসের মধ্যে সীমাবদ্ধ। ইয়েস’ ছাড়া অন্য কোনো ইংরেজি শব্দ তিনি এখনো শিখে উঠতে পারেন নি বলে মনে হলো। তার সঙ্গে কথাবার্তার কিছু নমুনা দেই।
আমার নাম হুমায়ুন। আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশ–তোমরা যাকে বলে মানছালা।
ইয়েস। [মুখ ভর্তি হাসি। মনে হলো আমার পরিচয় পেয়ে খুব আনন্দিত।]
তুমি কি শুধু উপন্যাসই লেখো? না কবিতাও লেখো?
ইয়েস। [আবার হাসি, খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে।]
আজকের পার্টি তোমার কেমন লাগছে?
ইয়েস। ইয়েস। [হাসি এবং মাথা নাড়া। মনে হলো আমার সঙ্গে কথা বলে তিনি খুব আরাম পাচ্ছেন।]
ভারতীয় মহিলা কবি গগন গিলের সঙ্গে দেখা হলো এই পার্টিতেই। লেখকদের মধ্যে তিনিই সবচে’ কমবয়েসি। চব্বিশ-পঁচিশের বেশি হবে না। অত্যন্ত রূপবতী। মেরুন রঙের সিল্কের শাড়িতে তাঁকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। ভদ্রমহিলার হাতে মদের গ্লাস, নির্বিকার ভঙ্গিতে ভুসভুস করে সিগারেট টানছেন। শাড়ি পরা কোনো মহিলার মদ পান এবং সিগারেট টানার দৃশ্যের সঙ্গে তেমন পরিচয় নেই বলে খানিকটা অস্বস্তি লাগছে, যদিও জানি অস্বস্তি লাগার কিছুই নেই। পুরুষরা যা পারে ওরাও তা পারে ওরা বরং আরো বেশি পারে, ওরা গর্ভধারণ করতে পারে আমরা পুরুষরা তা পারি না।
পার্টির শেষে আমি আহমদ তেহারিকে কম্পাসটা দিলাম। তিনি বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমার কাছ থেকে এটা তিনি আশা করেন নি বলে মনে হলো। মানুষের বিস্মিত মুখের ছবি–বড়াই চমৎকার। আমার দেখতে খুব ভালো লাগে।
তোহারি তোমার জন্যে আমার সামান্য উপহার। উপহারটি কাজে লাগলে আমি খুশি হব।
লেখকরা খুব আবেগপ্রবণ হন এই কথা বোধ হয় মিথ্যা নয়, তেহারি ‘মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড’ ‘মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড’ বলে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সবাই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল, একজন পুরুষ অন্য একজন পুরুষকে জড়িয়ে ধরেছে এই দৃশ্য তাদের কাছে খুব রুচিকর নয়।
নিজের অস্তিানা ভুতুড়ে বাড়িতে ফিরছি তবে ভূতের হাত থেকে রক্ষা পাবার ব্যবস্থা করে ফিরছি। স্টিফান কিং-এর একটি ভৌতিক উপন্যাস কিনে নিয়েছি। বিষে বিষক্ষয়ের মতো ভূতে ভূতক্ষয়।
বাসায় ফিরে দেখি স্টিফান কিং-এর উপন্যাস কেনার দরকার ছিল না। ফিলিপাইনের ঔপন্যাসিক রোজেলিও সিকাটকে আমার এখানে দিয়ে গেছে। তিনিও দেরিতে এসেছেন বলে মে ফ্লাওয়ারে জায়গা হয় নি।
রোজেলিও সিকাটের বয়স পঞ্চাশ তবে দেখায় তার চেয়েও বেশি। মাথায় চুল সবই সাদা। দাঁত বাঁধানো। অল্প কিছু দাড়িগোঁফ আছে। মুখের গঠন অনেকটা আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো। চেইন স্মোকার।
সিকাট ইউনিভার্সিটি অব ফিলিপাইনের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। নিজ দেশে তার খ্যাতি তুঙ্গ স্পর্শী। তাকে অত্যন্ত বিরক্ত মনে হলো। আমাকে বললেন, এদের কারবারটা দেখলে? এরা আমাকে মে ফ্লাওয়ারে জায়গা দেয় নি–এই বাড়িতে নির্বাসন দিয়েছে।
নির্বাসন বলছ কেন?
নির্বাসন না তো কি? সব লেখকরা দল বেঁধে মে ফ্লাওয়ারে আছেন আর আমি কি-না এখানে।
বাড়িটা কি তোমার পছন্দ হচ্ছে না?
পছন্দ হবে না কেন? পছন্দ হয়েছে। বাড়ি খুবই সুন্দর। কিন্তু প্রশ্নটা হলো নীতির। তুমি সম্ভবত জানো না এর আগে চারজন লেখককে এই বাড়িতে থাকতে বলা হয়েছিল। চারজনই অস্বীকার করেছেন।
তাই নাকি?
হ্যাঁ তাই। রোমানিয়ার কবি মির্চাকে (মির্চা কাক্টেরেষকু) এই বাড়ি দেয়া হলে তিনি ওদের মুখের ওপর বলেছেন–এটা একটা ‘Ghetto’। এই Ghetto-তে আমি থাকব না। আমাকে আপনারা বুখারেস্টের প্লেনে তুলে দিন।
তুমিও ওদের তাই বলো।
অবশ্যই বলব। রাগটা ঠিকমত উঠছে না। রাগ উঠলেই বলব। আমাকে দেখে মনে হয় না কিন্তু আসলে আমি খুবই রাগী মানুষ। জার্মানিতে আমি একবার মারামারি পর্যন্ত করেছি।
সে কি!
এক জার্মান যুবক আমাকে দেখে তামাশা করে কি সব বলছিল, দাঁত বের করে হাসছিল, গদাম করে তার পেটে ঘুসি বসিয়ে দিলাম। এক ঘুসিতে ঠাণ্ডা।
আমি অবাক হয়ে দ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, এখানে অবশ্য তেমন কিছু করা যাবে না।
করা যাবে না কেন?
করা যাবে না কারণ আসার আগে আমি আমার স্ত্রীর কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি রাগারাগি করব না। আমি আবার তাকে খুবই ভালোবাসি।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। সে বড়ই ভালোমেয়ে এবং রূপবতী।