হ্যাঁ খুবই মজার ব্যাপার।
তোমার সঙ্গে আমার আরো কিছু মিল আছে। কাগজপত্র ঘেঁটে দেখলাম তুমি Ph.D করেছ নর্থ ডেকোটা থেকে। আমার জন্যও নর্থ ডেকোটায়। এসো আমরা কফি খেতে খেতে গল্প করি।
কফির মগ হাতে তিনি দল ছেড়ে বাইরে গেলেন, আমি গেলাম তার পেছনে পেছনে। তিনি গলার স্বর নামিয়ে বললেন, ওয়াশিংটন থেকে টেলেক্স করে তোমার পারিবারিক দুর্ঘটনার খবর আমাকে জানিয়েছে। আমি খুবই দুঃখিত। তবু তুমি যে এসেছ এতেও আনন্দ পাচ্ছি। বাংলাদেশ থেকে এই প্রথম ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামে কাউকে পেলাম।
আগে আর কেউ আসেন নি?
না। তবে তোমাদের কবি জসীমুদ্দিনের মেয়ে হাসনা ছিল। সে অবশ্য রাইটিং প্রোগ্রামে ছিল না। সে ছিল আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। তুমি কি তাকে চেনো?
না আমি চিনি না। আমার চেনাজানার গণ্ডি খুবই সীমিত।
ভারতীর সঙ্গে আমি তোমার পরিচয় করিয়ে দেব। ও এখন আছে ক্যালিফোর্নিয়ায়। সেও অধ্যাপনা করে। ভারতী এলে তোমাকে দেখিয়ে দেবে কোন গ্রোসারিতে হলুদ, মরিচ, ধনিয়া পাওয়া যায়। ও সব জানে।
ধন্যবাদ প্রফেসর ব্লেইস।
তুমি তো অনেক দিন পর এ দেশে এলে, কেমন লাগছে?
এখনো বুঝতে পারছি না।
খুব শীত পড়বে কিন্তু। গরম কাপড় কিনে নিও। কোনোরকম অসুবিধা হলে আমাকে জানিও। আমি জানি বাঙালিরা মুখচোরা ধরনের হয়। আমেরিকায় যতক্ষণ থাকবে ততক্ষণ আমেরিকানদের মতোই থাকবে।
আমরা লেখদের দলে ফিরে এলাম। লেখকদের মধ্যে একজন শাড়ি পরা মহিলা। সম্ভবত ভারতের কবি গগন গিল। এগিয়ে গেলাম–না গগন গিল নন ইনি শ্রীলংকার কবি জেন, উনি সঙ্গে তাঁর স্বামীকে নিয়ে এসেছেন। স্বামী বেচারাকে মনে হলো স্ত্রীর প্রতিভায় মুগ্ধ। হাঁ করে সারাক্ষণ স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। কবি জেন-এর কথা বলা রোগ আছে। মনে হয় অনেকক্ষণ কথা বলার কাউকে পাচ্ছিলেন না, আমাকে পেয়ে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হলেন। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ খুলে এক তাড়া কাগজ বের করে বললেন আমি ‘গোয়া নিয়ে একটি কবিতা লিখেছি। এসো তোমাকে পড়ে শোনাই। শুনতে আপত্তি নেই তো?
প্রথম আলাপেই অভদ্র হওয়া যায় না, আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। ভদ্রমহিলা সঙ্গে সঙ্গে আবৃত্তি শুরু করলেন ইংরেজি কবিতা। সেই কবিতাও মহাভারতের সাইজের, শেষ হতে চায় না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে আমার পায়ে ঝি ঝি ধরে গেল। এ কি বিপদে পড়লাম। চোখে-মুখে আগ্রহের ভাব ধরে রাখতে হচ্ছে। যাতে আমাকে দেখে মনে হয় কবিতার প্রতিটি শব্দ আমাকে অভিভূত করছে। এ বড় কঠিন অভিনয়। এক সময় কাব্য পাঠ শেষ হলো। জেন উজ্জ্বল মুখে বললেন,
কেমন লাগল বলো তো?
অসাধারণ।
থ্যাংক ইউ। থ্যাংক ইউ। তোমার কি ধারণা কবিতাট: একটু অদ্ভুত?
কিছুটা অদ্ভুত তো বটেই।
সবাই তাই বলে। জানো, আমি সহজ করে লিখতে চাই কিন্তু মাঝামাঝি এসে সুররিয়েলিস্টিক হয়ে যায়। মনে হয় অন্য কেউ যেন আমার মাঝে কাজ করে। সে আমাকে দিয়ে কিছু লিখিয়ে নেয়।
ভদ্রমহিলার স্বামী বললেন, ওগো তুমি হুমায়ুনকে ঐ কবিতাটা শোনাও-ঐ যে কাফুর রাতে তুমি রাস্তায় হাঁটছিলে।
জেন সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় কবিতা বের করলেন। আয়তনে সেটি প্রথমটির দ্বিগুণ। দ্বিতীয় কবিতা শুনলাম তারপর তৃতীয় কবিতা শুনলাম এবং শুকনো মুখে বললাম আমি এখন একটু করিডোরে যাব। আমাকে সিগারেট খেতে হবে।
দ্রমহিলা এবং তার স্বামী কবিতার গোছা নিয়ে অন্য একজনের কাছে ছুটে গেলেন। আমি সিগারেট ধরিয়ে অলস ভঙ্গিতে করিডোর ধরে হাঁটছি। করিডোরের শেষ প্রান্তে বিরস মুখে দাঁড়িয়ে আছেন ইন্দোনেশীয় ঔপন্যাসিক তেহারি। আহমেদ তোহারি। ছোটখাটো মানুষ, দেখলেই স্কুলের নবম শ্রেণীর বালক বলে ভ্রম হয়। নতুন দাড়ি-গোফ গজানোর কারণে যে বালক বিব্রত এবং লোকচক্ষুর আড়ালে থাকার রোগ যাকে সম্প্রতি ধরেছে।
আহমেদ তোহারি তাঁর দেশে অতি জনপ্রিয়। তাঁর পাঁচটি উপন্যাস জাপানি ভাষায় অনূদিত ও সমাদৃত হয়েছে। সম্প্রতি তিনি তার দেশের সবচে বড় সাহিত্য পুরস্কারটি পেয়েছেন। বয়স ৪১, আমি নিজের পরিচয় দিতেই আনন্দিত হবার ভঙ্গি করলেন। তার ইংরেজি জ্ঞান, ইয়েস এবং নোর চেয়ে একটু বেশি তবে খুব বেশি না। নিজেকে প্রকাশ করতে তাঁর প্রচুর সময় লাগে। মনে হলো এই নিয়েও তিনি বিব্রত। নিজেকে অন্যদের থেকে দূরে সরিয়ে রাখার এটিও একটা কারণ হতে পারে।
আহমেদ তোহারি বললেন, তুমি কি আমাকে একটু সাহায্য করতে পারো?
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, কি সাহায্য?
তুমি কি একটা ভালো কম্পাস কিনে দেবার ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে? কম্পাস না থাকায় নামাজ পড়তে অসুবিধা হচ্ছে। কাবার দিক ঠিক করতে পারছি না।
অবশই কম্পাস কেনার ব্যাপারে আমি তোমাকে সাহায্য করব। তবে আমি কি তোমাকে ছোট্ট একটা প্রশ্ন করতে পারি?
হ্যাঁ পারো।
তুমি যখন জাকার্তা থেকে বিমানে করে ওয়াশিংটন এসেছ তখন তোমাকে কুড়ি ঘন্টা বিমানে থাকতে হয়েছে। এই সময়ে কয়েকবার নামাজের সময় হয়েছে, কাবা শরীফ তখন ছিল তোমার নিচে। সেই সময় নামাজ কি ভাবে পড়েছ?
তেহারি জবাব না দিয়ে অত্যন্ত ব্যথিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুসলমান হয়ে এই কথা বলব তা তিনি সম্ভবত কল্পনা করেন নি। আমারো বেশ খারাপ লাগল। এই কূটতর্কের কোনোই প্রয়োজন ছিল না।