I will love you on Tuesday.
মেয়েটি তার প্রেমিককে শুধু মঙ্গলবারে ভালোবাসতে চায় কেন? সপ্তাহের অন্যদিনগুলি কি দোষ করল? এই ভাবতে ভাবতে ঝিমুনী ধরে গেল।
হুমায়ুন। নামো আমরা এসে গেছি।
চোখ কচলাতে কচলাতে গাড়ি থেকে নামলাম। আধো অন্ধকার, আধো ছায়ায় মেপল এবং বার্চ গাছে ঢাকা বিশাল লাল ইটের দোতলা দালানের সামনে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। হুহু করে বইছে শীতের হাওয়া। বিকট শব্দে ঝি ঝি পোকা ডাকছে। আমেরিকান ঝি ঝি পোকা বড় বেশি শব্দ করে। আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, এইখানে থাকব?
হুঁ।
আমি একা?
হ্যাঁ।
সে কি-আমাকে তো বলা হয়েছিল মে ফ্লাওয়ারের কথা।
তুমি দেরি করে এসেছ তাই মে ফ্লাওয়ার তোমাকে দেয়া যায় নি। আমরা তোমার জন্যে এই বাড়ি ভাড়া করেছি। বাড়ি তোমার পছন্দ হবে। দেড়শ’ বছরের পুরানো বাড়ি। এক সময় স্কুল হাউস ছিল। ছোট ছোট বাচ্চারা পড়ত। তুমি শুনে খুশি হবে এই বাড়ি হিস্টোরিকাল প্রিজার্ভেশন পুরস্কার পেয়েছে। আমরা অনেক খুঁজে পেতে এই বাড়ি বের করেছি।
আমি শুকনো গলায় বললাম, থ্যাংকস। কিন্তু বাড়িতে ঢুকে আমার কাঁপুনি ধরে গেল। এই নির্জনপুরীতে একা থাকব কি করে? ভয়েই তো মারা যাব। ভূত প্রেত আছে কি-না কে জানে। পুরানো বাড়ি ভূতদের খুব প্রিয় হয় বলে জানি।
হুমায়ুন বাড়ি পছন্দ হয়েছে তো?
হয়েছে। কিন্তু কথা হলো–ভূত-প্রেত নেই তো?
লেম কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, থাকতেও পারে। পুরানো বাড়ি বুঝতেই পারছ। গুড নাইট, শ্লিপ টাইট।।
স্লিপ টাইট মানে? ভয়ে আমার আত্মা শুকিয়ে গেল। ঘুমুতে গেলাম ঘরের সব ক’টা বাতি জ্বালিয়ে। বলাই বাহুল্য ঘুম এলো না। আমার তিন কন্যা এবং কন্যাদের মা’র জন্য বড় মন কেমন করতে লাগল। কেন বোকার মতো ওদের ছেড়ে এসেছি। কি আছে এখানে? একা একা এই ভুতুড়ে বাড়িতে নিশিযাপনের কোনো মানে হয়?
শেষ রাতের দিকে মনে হলো কাঠের মেঝেতে পা টেনে টেনে কে যেন হাঁটছে। কাঁচ কাঁচ শব্দ হচ্ছে–কেউ বোধ হয় বাথরুমের দরজা খুলে বের হচ্ছে সেখান থেকে। পরিস্কার নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ পেলাম। আমি ভয়ে আধমরা হয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম–Who is there? ইংরেজিতে বললাম কারণ আমেরিকান ভূত বাংলা নাও বুঝতে পারে। প্রশ্ন করে আৱো ভয় পেয়ে গেলাম কারণ ভূত যদি সত্যি সত্যি প্রশ্নের উত্তর দেয় তাহলে হার্টফেল করে মরে যাওয়া ছাড়া কোনো পথ নেই। মেঝেতে হেঁটে আসার শব্দ। আমার শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে আসছে। আমি নিশ্চিত এখন কেউ কোমল গলায় বলবে–হে বিদেশী আমি এখানে বড়ই নিঃসঙ্গ। আমি খানিকক্ষণ তোমার সঙ্গে এই জীবনের হতাশা ও বেদনা নিয়ে কথা বলতে চাই। তুমি কি দয়া করে বাতি নিভিয়ে দেবে?
তেমন কিছু হলো না। পদশব্দ দরজার কাছে থেমে গেল। ঘুমানোর চেষ্টা করা বৃথা। আমি হাত বাড়িয়ে কবিতার বই টেনে নিলাম। কবিতা পড়ে যদি ভূতের ভয় কাটানো যায়। হিথ্রো বিমানবন্দরে এক গাদা বই কিনেছি। তার মধ্যে পণ্ডিত নেহেরুর প্রিয় কবি রবার্ট ফ্রস্ট আছেন। যার ‘Stopping by woods on a snowing evening’ কবিতার প্রতি ভারতবাসীর দৃষ্টি তিনিই প্রথম আকৃষ্ট করেন।
কবিতা আমার প্রিয় বিষয় নয় তবু এই ভয়ংকর রাতে কবিতাই আমাকে উদ্ধার করল। পড়তে পড়তে ভূতের ভয় কেটে গেল। The woods are lovely dark and deep
But I have promises to keep
And miles to go before I sleep
And miles to go before I sleep.
পৃথিবীর নানান জায়গা থেকে পঁয়তাল্লিশ জন লেখক
পৃথিবীর নানান জায়গা থেকে পঁয়তাল্লিশ জন লেখক একত্র হয়েছেন। সবাই পরিণত বয়স্ক। অনেকেরই চুল-দাড়ি ধবধবে সাদা। নিজেকে এদের মধ্যে খুবই অল্প বয়স্ক লাগছিল। যদিও ভালো করেই জানি মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়েছে। উনিশ বছরের যুক্তিহীন আবেগময় যৌবন পেছনে ফেলে এসেছি অনেক অনেক আগে।
লেখকদের কাউকেই চিনি না। কারো কোনো বইও আগে পড়ি নি। তবে ভাবভঙ্গিতে বুঝলাম যারা এসেছেন সবাই তাদের দেশের অতি সম্মানিত লেখক। সবার লেখাই একাধিক বিদেশী ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। প্রোগ্রামটির পরিচালক প্রফেসর ক্লার্ক ব্লেইস নিজেও আমেরিকার নাম করা ঔপন্যাসিকদের একজন। তার একটি উপন্যাসের ওপর ভিত্তি করে আমেরিকার একটি বড় ফ্লিম কোম্পানি এই মুহূর্তে ছবি তৈরি করছে।
প্রফেসর ক্লার্ক বুড়ো মানুষ। ধবধবে শাদা দাড়ি–ঋষি ঋষি চেহারা। এক পর্যায়ে তিনি আমার কাছে এগিয়ে এসে আমাকে চমকে দিয়ে পরিষ্কার বাংলায় বললেন, কেমন আছ হুমায়ূন?
উত্তর দেব কি, হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। প্রফেসর ক্লার্ক আমার বিস্ময় খুব উপভোগ করলেন বলে মনে হলো। আমি কিছু বলার আগেই আমাকে আরো চমকে দিয়ে বললেন, আমি সম্পর্কে তোমাদের জামাই হই।
এর মানে কি? কি বলছেন উনি? আমাকে বেশিক্ষণ হতচকিত অবস্থায় থাকতে হলো না। প্রফেসর ক্লার্ক তার বক্তব্য ব্যাখ্যা করলেন। ইংরেজিতে বললেন, আমি একটি বাঙালি মেয়ে বিয়ে করেছি, কাজেই আমি তোমাদের জামাই। আমার স্ত্রীর নাম ভারতী মুখোপাধ্যায়। কোলকাতার মেয়ে।
বলো কি?
খুব অবাক হয়েছ?
তা হয়েছি।
বাংলাদেশের কোন জায়গায় তোমার জন্ম?
ময়মনসিংহ।
ভারতীর দেশও ময়মনসিংহ–মজার ব্যাপার না?