এগুলি হচ্ছে মাথা ধরার অষুধ। কমার্শিয়াল নেম প্যারাসিটামল। এক ধরনের এনালজেসিক। ক্যামিকেল কম্পোজিশন এসিটামিনোফেন।
এগুলি তুমি কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
আমেরিকায়।
আমেরিকায় কি এ ধরনের অষুধ পাওয়া যায় না?
পাওয়া যায় নিশ্চয়ই, তবু নিয়ে যাচ্ছি।
কি করবে?
খাব।
দেখি তোমার পাসপোর্ট।
দিলাম পাসপোর্ট। সে অতি মনোযোগে পাতা উল্টে দেখতে লাগল। যেন এটা জাল পাসপোর্ট। দেখা গেল আমার মতো আরো দুর্ভাগা আছে। সিলিটে এক পরিবার ধরা খেয়েছে। বাবা-মা এবং ছ’টি নানান সাইজের ছেলেমেয়ে। এদের একজনের হাতে পলিথিনের কাগজে মোড়া বিশাল আকৃতির দুটি মানকচু। পরিবারের কর্তা করুণ গলায় ক্রমাগত বলছে–আই ব্রিটিশ, ফ্যামিলি ব্রিটিশ। অল চিলড্রেন বর্ন ব্রিটিশ। আই ব্রিটিশ কান্ট্রি লিভ থার্টি ইয়ার।
যে পুলিশ অফিসার ওদের নিয়ে এসেছে সে এইসব কথাবার্তায় মোটেই কান দিচ্ছে না। সে সবার হাত থেকে পাসপোর্ট নিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে অন্য একটা ঘরে ঢুকে পড়ল। পরিবারের কর্তা আমাকে বললেন, ওরা আফনারে দরল কি কারণ?
আমি বললাম, এখনো বুঝতে পারছি না।
ভাইছাব, মনে মনে দুয়া ইউনুস পড়েন। এরা বড় হারামি জাত।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললাম।
দরিদ্র দেশে জন্মগ্রহণের অনেক যন্ত্রণা।
মাঝরাতে আমেরিকার আইওয়া স্টেটে
মাঝরাতে আমেরিকার আইওয়া স্টেটের ছোট্ট শহর সিডার রেডিস-এ বিমান থামল। প্রায় দশ বছর পর এই দেশে আসছি। চারদিকে তাকাচ্ছি। কিন্তু দশ বছরে কি পরিবর্তন হলো তা দেখার তেমন আগ্রহ বোধ করছি না। আমেরিকা কতটুকু বদলালো তা দিয়ে আমার কি? আমার দেশে দশ বছরে কিছুই হয় নি এই আমার চিন্তা। চারদিকে তাকানোর উদ্দেশ্য–দেখা কেউ আমাকে নিতে এলো কি না। না এলে খুব চিন্তার কথা। অচেনা শহরে ট্যাক্সি ভাড়া করে হোটেলে উঠতে হবে। তাও দুপুর রাতে। পকেটে একশ’ ডলারের একটা নোট, তা দিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া এবং হোটেল ভাড়া হবে কি-না কে জানে। কাউকে দেখতে পেলাম না। এটাই স্বাভাবিক। আজ উইক এন্ডের রাত। আমেরিকানরা হৈচৈ করে ছুটি কাটাচ্ছে। কার দায় পড়েছে মাঝরাতে এয়ারপোর্টে এসে বসে থাকার?
আমি পুরো পরিস্থিতি ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করার জন্যে ভেন্ডিং মেশিন থেকে গরম কফি কিনলাম। সিগারেট ধরাব কি না বুঝতে পারছি না। সিগারেট খাওয়া এখানে ড্রাগ খাওয়ার মতো হয়ে গেছে। সব জায়গায় নো স্মোকিং। সিগারেট ধরালেও সমস্যা–চারদিক এত ঝকঝক-তকতকে ছাই ফেলব কোথায়? যেখানে সেখানে ছাই ফেলার এবং ওয়াক থু বলে থুথু ফেলার যে মজা তা এরা কোনোদিন জানবে না।
কিছু মনে করবে না। তুমি কি বাংলাদেশের লেখক ড. হুমায়ুন? আমি চমকে তাকালাম।
ইন্ডিয়ান-আমেরিকানদের মতো দেখতে বিশাল দেহী এক যুবক দাঁড়িয়ে। মাথায় টেক্সানদের হ্যাট। মুখ হাসি হাসি। আমি হাসি মুখে মাথা নাড়লাম।
আমার নাম লেম। আমি আন্তর্জাতিক লেখক সম্মেলনের সঙ্গে জড়িত। আমি তোমাকে নিতে এসেছি।
ধন্যবাদ। মনে হচ্ছে আমি তোমার উইক এন্ড মাটি করেছি।
তা করেছ। আমি অনেকক্ষণ থেকেই তোমাকে লক্ষ করছি। তুমি যে লেখক বুঝতে পারি নি। তোমার চেহারা লেখকদের মতো নয়।
লেখকদের চেহারা কেমন থাকে বলো তো?
লেম হাসতে হাসতে বলল, তাও তো জানি না। তোমার লাগেজ কোথায়?
আমি আমার স্যুটকেস দেখিয়ে দিলাম। লেম বিস্ময় মাখা গলায় বলল, হলি কাউ! এটা স্যুটকেস?
হ্যাঁ।
আমি ছোট গাড়ি নিয়ে এসেছি। এই জিনিস গাড়িতে ঢুকবে না। এটা বরং এখানে থাক। ভোরে বড় গাড়ি করে নিয়ে যাব।
বেশ তো, তাই করো।
আমরা যাব আইওয়া সিটিতে। তোমাকে তোমার আস্তানায় নামিয়ে দিয়ে চলে যাব। ভোরবেলা আবর এসে অন্যান্য লেখকদের সঙ্গে তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেব।
ধন্যবাদ।
তুমি কি বাংলায় লেখালেখি করো?
হ্যাঁ।
বাংলায় লেখালেখি করেন এমন লেখক এই প্রোগ্রামে খুব বেশি আসেননি। একজন শুধু এসেছিলেন, দু’বার এসেছিলেন।
তাঁর নাম কি?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তুমি কি তাকে চেনো?
খানিকটা চিনি তবে তার লেখার সঙ্গে পরিচিত।
আমরা গাড়িতে উঠলাম। লেম বলল, দয়া করে সিট বেল্ট বেঁধে নাও। আইওয়া রাজ্যে সিট বেল্ট না বাঁধলে সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারের জরিমানা।
আমি সিট বেল্ট বাঁধলাম। গাড়ি ঝড়ের গতিতে উড়ে চলল। বিশ্ববিখ্যাত আমেরিকান হাইওয়ে। এই হাইওয়েতে গুলতেকিন এবং আমার বড় মেয়ে নোভাকে নিয়ে কত না ঘুরা ঘুরেছি। এক শীতের রাতে ক্রমাগত গাড়ি চালানোর রেকর্ড করব ভেবে সারারাত গাড়ি চালিয়েছিলাম। এক মুহূর্তের জন্যেও না থেমে ফার্গো থেকে গিয়েছিলাম মন্টানার বনভূমিতে।
আমি পুরানো আমেরিকা দেখার চেষ্টা করছি। কুয়াশা পড়েছে। তেমন কিছু দেখা যাচ্ছে না। গাছপালা বা পাহাড়-পর্বত চোখে পড়ছে না। মনে হচ্ছে প্রেইরির সমভূমি।
লেম!
ইয়েস প্লিজ।
তোমাদের এটা কি সমভূমি? ফ্ল্যাট ল্যান্ড?
না। এটাকে বলে রোলিং কান্ট্রি। ঢেউ-এর মতো উঁচু নিচু। আইওয়া হচ্ছে পৃথিবীর সেরা কর্ন প্রডিউসিং এলাকা।
লেম গাড়ির রেডিও চালু করে দিল। ভুলেই গিয়েছিলাম রাতের বেলা হাইওয়েতে গাড়ি নিয়ে নামলে এরা অবশ্যই রেডিও চালু রাখে। যাতে চলন্ত গাড়িতে ঘুমিয়ে না পড়ে। চোখ এবং কান থাকে সজাগ। রেডিওতে একটি মেয়ে অত্যন্তু মিষ্টি গলায় গাইছে–