নিউ জার্সির প্রবাসী বাঙালিদের ছেলেমেয়েদের অবস্থা অবশ্যি ভত খারাপ নয়। এরা একসঙ্গে হেসে-খেলেই বড় হচ্ছে। বাংলা শেখার স্কুল আছে, নাচের স্কুল আছে। গানের স্কুল আছে। প্রবাসী বাঙালিদের বৃদ্ধ বাবা-মারা দেশ থেকে নাতি-নাতনিদের দেখতে যাচ্ছেন। তিন মাস, তিন মাস করে থাকছেন।
প্রবাসী বাঙালিদের অভিমত হলো–প্রথম জেনারেশনেই শুধু প্রবাসে থাকার কষ্ট ভোগ করবে। দ্বিতীয় জেনারেশন করবে না, কারণ তাদের বাবা, মা, ভাই, বোন সব এই দেশেই থাকবে। তৃতীয় জেনারেশনে এরা শুধু যে বাবা-মা পাবে তাই না, খালা-খালু চাচা-চাচী সবই পেয়ে যাবে।
আমি তাদের যুক্তি মেনে নিলাম, অবশ্যি মনে মনে বললাম, সবই পাবে। শুধু পাবে না ‘দেশ’।
পরে ভেবে দেখলাম আমার এই কথাও তো ঠিক নয়। দেশ কেন পাবে না? দেশ হবে আমেরিকা। তাতে ক্ষতি কি। আসলে আমরা কি বিশ্ব নাগরিক নই। পৃথিবী হচ্ছে আমাদের জন্মভূমি–এটা ভাবলেই সব সমস্যার সমাধান।
যখন বয়স কম ছিল তখন বিদেশে থেকে যাওয়া বাংলাদেশীদের কথা ভাবলে খানিক মন খারাপ হতো। এখন হয় না। এখন মনে হয় কর্ম এবং জীবিকার খাতিরে দেশত্যাগে ক্ষতি কি? বাংলাদেশের মানুষ ছড়িয়ে পড়ুক পৃথিবীময়। জনসংখ্যার ভারে পর্যুদস্ত বাংলাদেশের এতে লভি বই ক্ষতি হবে না। প্রবাসী ইহুদিদের কল্যাণেই তো আজ ইসরাইল এত ক্ষমতাবান একটি দেশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই হবে।
আমি নিউ জার্সিতে তার লক্ষণও দেখলাম। বাংলাদেশ সমিতি নামে নিউ জার্সির যে সমিতি তা দেশের জন্যে ক্রমাগত কাজ করে যাচ্ছে। দেশের যে কোনো বিপদে যে পরিমাণ অর্থ তারা দান করছে তার পরিমাণ শুনলে মাথা ঘুরে যায়। একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকার কথাও তো আজ আমাদের জানতে বাকি নেই।
প্রসঙ্গক্রমে প্রবাসী বাঙালি পরিবারের একজনের কথা বলি। তিনি ছেলের জন্মদিন করবেন। দাওয়াতের চিঠি পাঠালেন। চিঠিতে লেখা আমার ছেলের জন্মদিন উপলক্ষে উপহার কেনা বাবদ যে পরিমাণ অর্থ আপনি বরাদ্দ করে রেখেছিলেন দয়া করে সেই অর্থ–বাংলাদেশ সাহায্যকল্প প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠান সেবায় দান করুন।
বাংলাদেশ সোসাইটি শিল্প-সাহিত্যের ধারাটি তাদের মধ্যে প্রবাহিত রাখার অংশ হিসেবে দেশের নামি কবি-সাহিত্যিক দাওয়াত করে নিয়ে যাচ্ছেন। অনুষ্ঠান করছেন। এই তো কিছুদিন আগে ঘুরে গেলেন কবি শামসুর রাহমান।
আমি থাকতে থাকতেই সঙ্গীত অনুষ্ঠান হলো কাদেরী কিবরিয়ার। সবার মধ্যে কত আনন্দ, কত উৎসাহ।
ষোলই ডিসেম্বরে বিজয় দিবস উৎসব হবে। দীর্ঘদিন ধরে চলছে তার রিহার্সেল। কত না উত্তেজনা সবার মধ্যে। দেখে বড় ভালো লাগল। অসহায় বাংলা মা’কে এরা ভুলেন নি–এই জীবনে ভুলতে পারবেনও না। বাংলাদেশ আর কিছু পারুক না পারুক এক দল পাগল ছেলে তৈরি করে পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিয়েছে। যারা বাংলাদেশ ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারে না।
ফিরে যাবার পালা
বন্দরের কাল হলো শেষ।
এখন ফিরে যাবার পালা। যেসব স্মৃতি নিয়ে ফিরছি তার বেশিরভাগই সুখ স্মৃতি নয়। তবু জানি প্লেনে ওঠা মাত্র মনে হবে কিছু চমৎকার সময় আমেরিকায় কাটিয়ে গেলাম। পাখি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় উড়ে যায় কিন্তু ফেলে যায় তার একটি পালক।
দেশে রওনা হবার দু’দিন আগে ভ্রাতৃবধূ ইয়াসমিন বলল, দাদাভাই চলুন আপনাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাই যার স্মৃতি অনেক দিন আপনার মনে থাকবে।
কোন জায়গা বলতো?
ওয়াশিংটন ডিসির স্মিথসোনয়ান ইন্সটিটিউট।
আগে একবার দেখেছি।
চাঁদের মাটি দেখেছেন?
চাঁদের মাটি তো বাংলাদেশেই দেখেছি। উনিশশ সত্তর সনে আমেরিকান এ্যাম্বেসি চন্দ্ৰশীলা নিয়ে এসেছিল।
‘চাঁদের মাটি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখেছেন?
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, চাঁদের মাটি হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখা যায়?
যায়। মিউজিয়ামে সেই ব্যবস্থা আছে। যাবেন?
অবশ্যই যাব। চাঁদের মাটি স্পর্শ করা তো চাদকে স্পর্শ করা। এই সুযোগ পাওয়া যাবে তাই তো কখনো কল্পনা করিনি।
আনন্দে আমার চোখ ঝলমল করতে লাগল। ইয়াসমিন হাসতে হাসতে বলল, আমি জানতাম চন্দ্ৰশীলা হাত দিয়ে ছোয়া যায় শুনে আপনি খুব একসাইটেড ফিল করবেন। এই কারণেই সবার শেষে আপনার জন্যে এই প্রোগ্রাম রেখে দিয়েছি।
সারাদিন গাড়ি চালিয়ে বিকেলে পৌঁছলাম মিউজিয়ামে। অনেক কিছুই দেখার আছে সেখানে রাইট ব্রাদার্সের তৈরি প্রথম বিমান, যে লুনার মডিউল চাঁদে নেমেছিল–সেই লুনার মডিউল আরো কত কি…।
কিছুই দেখলাম না, এগিয়ে গেলাম চন্দ্ৰশিলার দিকে।
উঁচু একটি আসনে চাঁদের মাটি সাজানো। উপরে লেখা এই চন্দ্ৰশিলা হাত দিয়ে স্পর্শ করা যাবে।
আমি এবং গুলতেকিন একসঙ্গে চাঁদের পাথরে হাত রাখলাম। আমার রোমাঞ্চ বোধ হলো। গভীর আবেগে চোখে পানি এসে গেল। কত না পূর্ণিমার রাত মুগ্ধ চোখে এই চাঁদের দিকে তাকিয়ে বিস্ময় ও আবেগে অভিভূত হয়েছি। সেই চাঁদ আজ স্পর্শ করলাম। আমার এই মানব জীবন ধন্য।
আমেরিকার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা বোধে মন দ্রবীভূত হলো। আমেরিকানদের অনেক দোষ-ত্রুটি, তবু তো এরা আমাকে এবং আমার মতো আরো অসংখ্য মানুষকে রোমাঞ্চ ও আবেগে অভিভূত হবার সুযোগ করে দিয়েছে। ধরা-ছোঁয়ার বাইরের যে চাঁদ তাকে নিয়ে এসেছে মাটির পৃথিবীতে। এই শতক শেষ হবার আগেই তারা যাত্রা করবে মঙ্গল গ্রহের দিকে। সমস্ত পৃথিবীর মানুষকে আবারো অভিভূত করবে। আমেরিকা আমি পছন্দ করি না তবু চন্দ্ৰশিলায় হাত রেখে মনে মনে বললাম–তোমাদের জয় হোক।