রুম সার্ভিসকে কফি এবং খবরের কাগজ দিতে বলেছি। সে নিউইয়র্ক টাইমস দিয়ে গেল। অবাক হয়ে দেখি নিউইয়র্ক টাইমস-এর শেষ পাতায় বাংলাদেশ সম্পর্কে একটা খবর ছাপা হয়েছে। জনতার প্রবল দাবির মুখে প্রেসিডেন্ট এরশাদ পদত্যাগ করেছেন। বর্তমানে তার পালক পুত্র এবং পালক কন্যাসহ গৃহবন্দি আছেন।
বাংলাদেশে কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই জানতাম না। এই খবরে বিস্ময়ের সীমা রইল না। এত বড় একটা খবর অথচ আমেরিকান পত্রিকায় এত ছোট করে ছাপা হয়েছে দেখেও খারাপ লাগল। ছাত্ররা এত ক্ষমতাবান একজন ডিক্টেটরকে সিংহাসন থেকে নামিয়ে ফেলেছে। এই ঘটনা চীনের থিয়েনমেন স্কয়ারের চেয়ে কোনো অংশেই কম গুরুত্বপূর্ণ নয় অথচ কত হেলাফেলার সঙ্গেই না খবরটা এরা ছাপাল। এরশাদের যে একজন পালক কন্যাও ছিল তা জানতাম না–নিউইয়র্ক টাইমসের কল্যাণে জানলাম। পালক পুত্রটির ছবি লক্ষ বার দেখেছি। পলিক কন্যাকে কোনোদিন দেখিনি। এরশাদ নিশ্চয় বলে নি মেয়েটির ছবি ছাপা হোক। তাকে সবাই দেখুক।
কেন জানি ঐ পালক কন্যাটি খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। কেমন দেখতে ঐ মেয়েটি? কি তার নাম?
নিউ জার্সি শহরে বাঙালি
নিউ জার্সি শহরে আড়াইশ’র মতো বাঙালির বাস।
এই আড়াইশ’র একজন আমার ছোট ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল। কাজ করে বেল ল্যাবরেটরিতে। নিউক্লিয়ার ফিজিসিস্ট। গবেষণার বিষয় ফাইবার অপটিকস বা এই ধরনের কিছু। তারচেয়ে বড় পরিচয় সে বাংলা সাহিত্যের একজন লেখক এবং উঁচুমানের লেখক। তাঁর বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এবং শিশুদের জন্যে লেখা গ্রন্থগুলি আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে পড়ি, মাঝে মাঝে খানিকটা ঈর্ষাও যে করি না তা না।
নিউ অরলিন্স থেকে সরাসরি তার বাসায় গিয়ে উঠলাম। তার দুই বাচ্চা নাবিল এবং ইয়েসিম। দুজনই এয়ারপোর্টে খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিল বড় চাচা আসবেন। তাদের ধারণা বড় চাচা মানে সাইজে যিনি বড়। দুজনই আমার আকৃতি দেখে মনোক্ষুণ্ণ হলো। নাবিল নিখুঁত ইংরেজিতে বলল, তোমরা একে বড় চাচা কেন বলছ–He is small.
নাবিলের বয়স পাঁচ। ইংরেজি-বাংলা দুই-ই চমৎকার বলে। তার বোনের বয়স তিন, সে মিশ্র ভাষা ব্যবহার করে। উদাহরণ–Give my জামা খুলি অর্থাৎ আমার জামা খুলে দাও।
বাচ্চা দুটি একা একা থাকে। নিকট আত্মীয়স্বজনদের দেখা বড় একটা পায়। আমাকে এবং গুলতেকিনকে পেয়ে তাদের আনন্দের সীমা রইল না। তাদের আগ্রহ ও আনন্দের প্রধান কারণ আমরা বাংলাদেশের। বাচ্চা দুটিকে তাদের বাবা মা এমন এক ধারণা দিয়েছে যাতে তাদের কাছে বাংলাদেশ হচ্ছে স্বপ্নের দেশ। বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্নের মানুষ। আমি তাদের সেই ধারণা উসকে দেবার প্রাণপণ চেষ্টা করলাম। ইয়েসিম যখন তার রান্নাবাটি খেলার কাগজের খাবার আমাকে এনে দিল আমি কপ কপ করে সেই কাগজ খেয়ে দুই ভাই-বোনের মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি করলাম।
ওদের বাবা-মা দেখি বাচ্চা দুটিকে খুবই আধুনিক নিয়মে বড় করার চেষ্টা করছে। বাবা-মা দু’জনই পিএইচডি ডিগ্রিধারী এবং দীর্ঘদিন আমেরিকা প্রবাসী হলে এই বোধহয় হয়। ঘরে বাচ্চাদের জন্যে আইন-কানুন লেখা। যেমন
প্রথম আইন : কাঁদলে কোনো জিনিস পাওয়া যাবে না। কাজেই কেঁদে লাভ নেই।
দ্বিতীয় আইন : খেলনা কারোর একার নয়। খেলনা শেয়ার করতেই হবে।
আমি ইকবালকে বললাম, তোর কায়দা-কানুন তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কোনো একটা কিছু নিয়ে কেঁদে বাড়ি মাথায় না তুললে আর বাচ্চা কি! তোর নিয়মে তুই তো বাচ্চাদের বড়ো বানিয়ে ফেলছিস।
সে হেসে বলল, অনেক ভেবেচিন্তে এটা করছি। এক ধরনের এক্সপেরিমেন্ট। তোমরা হঠাৎ দেখছ বলে অন্য রকম লাগছে।
তাই হয়তো হবে। তাদের এক্সপেরিমেন্টে আমি এবং গুলতেকিন বাধা দিলাম না তবে একবার বেশ খারাপ লাগল। এদের নিয়ে খেলনার দোকানে গিয়েছি–নাবিলের একটা খেলনা পছন্দ হলো। তার বাবা বলল, নাবিল তিন নম্বর
আইনটি কি বলো তো?
নাবিল গড়গড় করে বলল, মাসে একটির বেশি খেলনা পাওয়া যাবে না।
তুমি কি এই মাসে খেলনা পেয়েছ?
তাহলে এটি চাচ্ছ কেন।
আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
তিন নম্বর আইন কি বলে? পছন্দ হলেই পাওয়া যাবে?
নাবিল ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে লাগল।
কাদলে লাভ হবে না ব্যাটা। এক নম্বর আইন কি বলে?
সে কাঁদতে কাঁদতে বলল, এক নম্বর আইন বলে কাঁদলে কিছু পাওয়া যাবে না।
তাহলে কাঁদছ কেন?
কান্না থামাতে পারছি না তাই কাঁদছি।
আমি আর থাকতে পারলাম না। বললাম, বাংলাদেশের একটা কঠিন আইন আছে। সেই আইন বলে–বড় ভাইরা ইচ্ছে করলে ছোট ভাইদের আইন ভাঙতে পারে। সেই বাংলাদেশী বিশেষ আইনে তোমাদের প্রথম আইন ভঙ্গ করা হলো। এখন তোমাকে তোমার প্রিয় জিনিস কিনে দেয়া হবে। এসো আমার সঙ্গে।
নাবিল আশা ও নিরাশা নিয়ে তাকাল তার বাবার দিকে। তার বাবা বলল,
বাংলাদেশী বিশেষ আইনের ওপর তো আর কথা চলে না। যাও তোমার বড় চাচার সঙ্গে।
আমেরিকায় যা দেখে আমি সবচে’ কষ্ট পেয়েছি তা হলো প্রবাসী বাঙালিদের ছেলে-মেয়ে। তারা বড়ই নিঃসঙ্গ। হ্যাঁ, বাবা-মা তাদের আছে, বন্ধুবান্ধব আছে, কিন্তু দু’কূল ভাসানো আদর কোথায়? পরিষ্কার মনে আছে আমার শৈশবের একটি বড় অংশ কেটেছে আত্মীয়স্বজনদের কোলে কোলে। আদরে মাখামাখি হয়ে। নানার বাড়ির কথা। গভীর রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল। মা’কে ডেকে তুলে বললাম ঘুম আসছে না। কোলে করে মাঠে হাঁটলে ঘুম আসবে। মা বিরক্ত মুখে বললেন, কি যন্ত্রণা। দিব পাখা দিয়ে এক বাড়ি। খালারা চেঁচিয়ে উঠলেন–আহা আহা আহা। তিন মামা বের হয়ে এলেন কোলে নিয়ে মাঠে হাঁটার জন্যে। শুধু হাঁটলে হবে না। হাঁটতে হাঁটতে গল্প বলতে হবে। আকাশ ভরা ফকফকা জোছনা। মাঠ ভর্তি জোছনার ফুল। সেই শৈশব এরা কোথায় পাবে?