সে তার ছোট স্যুটকেস অতি দ্রুত গুছিয়ে ফেলল; টুথব্রাশ, সাবান, তোয়ালে। তার কাণ্ড দেখে অন্যরা হাসছে কিন্তু কষ্টে আমার কান্না পাচ্ছে কি করে এদের ছেড়ে থাকব? কি করে কাটবে প্রবাসের দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী
আমার প্রকাশকদের একজন কাকলী প্রকাশনীর সেলিম সাহেবকেও আমার বিদেশ যাত্রায় খুব আনন্দিত মনে হলো। তিনি দুই ভাড় দৈ নিয়ে উপস্থিত হলেন। কোনোরকম আনন্দের ব্যাপার হলেই তিনি তাঁর দেশের বাড়ির মেষের টক দৈ নিয়ে উপস্থিত হন। অতি অখাদ্য সেই দৈ দেখলেই হৃৎকম্প হয়, তবু ভদ্রতা করে বলি–অসাধারণ।
সেলিম সাহেব দৈ-এর ভাড় রাখতে রাখতে হাসি মুখে বললেন, স্যার শুনলাম আপনি আমেরিকা যাচ্ছেন। শুনে বড় ভালো লাগছে।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, ভালো লাগছে কেন বলুন তো?
সেলিম সাহেব লাজুক ভঙ্গিতে বললেন, ফিরে এসে হোটেল গ্রেভার ইনের মতো একটা বই লিখে ফেলবেন। আমি ছাপব।
আমি তার আনন্দের কারণ এতক্ষণে বুঝলাম, আমেরিকান অভিজ্ঞতা নিয়ে হোটেল গ্রেভার ইন নামে কিছু স্কেচধর্মী লেখা লিখেছিলাম। সেই বই পাঠকরা আগ্রহ নিয়ে পড়েছে। এবং সেলিম সাহেব হচ্ছেন বইটির প্রকাশক।
স্যার আপনি যাওয়ার আগে আগে আরো দৈ দিয়ে যাব। আমার ছোট ভাইকে দেশে পাঠিয়েছি ও নিয়ে আসবে।
থ্যাংকস।
অনেকেই এই দৈ পছন্দ করে না। একমাত্র আপনাকেই দেখলাম আগ্রহ করে খান। ভালো জিনিসের মর্যাদা খুব কম মানুষই বোঝে।
আমি শুকনো গলায় বললাম, খুবই খাঁটি কথা?
বই-এর নামটা কি দিয়ে যাবেন? নাম দিয়ে গেলে কভার করে রাখতাম।
বইটির নাম হোটেল মে ফ্লাওয়ার।
হোটেল মে ফ্লাওয়ার?
হ্যাঁ, যে ডরমিটরিতে থাকব তার নাম মে ফ্লাওয়ার…
আর বলতে হবে না বুঝতে পেরেছি–তাহলে কভার করে ফেলি?
করে ফেলুন। আরেকটা কথা সেলিম সাহেব, ঐ দৈটা না আনলে হয় না?
বাঙালির বিদেশ যাত্রার প্রথম প্রস্তুতি
বাঙালির বিদেশ যাত্রার প্রথম প্রস্তুতি হচ্ছে সুটকেস ধার করা। নিজেদের যত ভালো স্যুটকেসই থাকুক বিদেশ যাত্রার আগে অন্যের কাছে স্যুটকেস ধার করতে হবে। এটাই নিয়ম।
গুলতেকিন অবশ্যি নিয়মের ব্যতিক্রম করল–স্যুটকেস কিনে অনিল। হুলস্থুল ধরনের বিশাল এক বস্তু। আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, এটা কি?
সে বিরক্ত হয়ে বলল, সব সময় রসিকতা ভালো লাগে না। একটু বড় সাইজ কিনেছি তাতে হয়েছে কি! স্যুটকেস হলো ঘড়ির মতো, যত ছোট তত দাম
বেশি। বেশি দাম দিয়ে ছোট জিনিস কেন কিনব?
কিছু মনে করো না গুলতেকিন, এই বস্তু এরোপ্লেনের দরজা দিয়ে ঢুকবে না। দরজা কেটে ঢুকাতে হবে।
দরজা কেটে ঢুকাতে হলে দরজা কেটে ঢুকাবে। আর এই নাও তোমার হ্যল্ডিব্যাগ।
হ্যান্ডব্যাগ দেখেও আমি চমৎকৃত হলাম। সেই হ্যান্ডব্যাগে নানান জায়গায় গোটা ত্রিশেক পকেট। আমি বিস্ময় মাখা গলায় বললাম, অদ্ভুত অদ্ভুত সব জিনিস তোমার চোখে পড়ে। এইটা তাহলে হ্যান্ডব্যাগ? ধরব কোথায়? হাতল বা কাঁধে ঝুলাবার ফিতা কোনোটাই তো দেখছি না।
দেখা গেল ঐ হ্যান্ডবাগে হীতে নেবার বা কাঁধে ঝুলাবার ব্যবস্থা নেই। বগলে নিয়ে ঘুরতে হবে। তাই সই।
যথাসময়ে হ্যান্ডব্যাগ বগলে নিয়ে এবং পর্বতপ্রমাণ স্যুটকেস টানতে টানতে এয়ারপোর্টে উপস্থিত হলাম। যিনি বোডিং কার্ড দেন তিনি বিস্ময়ে আপ্লুত হয়ে বললেন, এই সুটকেস আপনার? কোত্থেকে কিনেছেন বলুন তো?
বিমান আকাশে উড়ল এবং এক সময় বিমানবালার গলায় শুনতে পেলাম-তী হাজার ফুট উছতায়–অর্থাৎ আমরা ত্রিশ হাজার ফুট উচ্চতায় ভ্রমণ করছি। বাংলাদেশ বিমান এই অদ্ভুত উচ্চারণের বাংলা কোত্থেকে জোগাড় করেছে কে জানে। বাংলা একাডেমীর প্রাক্তন মহাপরিচালক মরহুম আবু হেনা মোস্তফা কামালের এই বিষয়ে একটি থিওরি আছে। তিনি মনে করেন এই উচ্চারণ ওরা পেয়েছে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে। এক সময় পি.আই. এর কোনো বাঙালি বিমানবালা ছিল না। উর্দুভাষী বিমানবালারা অনেক কষ্টে এইভাবে বাংলা বলত। সেই থেকে এটাই হয়ে গেল বিমানের স্টান্ডার্ড বাংলা উচ্চারণ। পাকিস্তানি ভূত এত সহজে ঘাড় থেকে নামবার নয়। এখনকার বাঙালি বিমানবালারা অনেক কষ্টে উর্দু উচ্চারণে বাংলা রপ্ত করে। এই উচ্চারণ এদের অনেক ত্যাগ এবং তিতিক্ষায় শিখতে হয়। ওদের ট্রেনিং-এর এটাই সবচে’ শক্ত পার্ট।
হিথ্রো বিমানবন্দরে পৌঁছলাম ভোরবেলা। বিমান থেকে নেমে ট্রানজিট লাউঞ্জে যাবার আগেই বিপদে পড়ে গেলাম। বিপদে পড়ব জানা কথা, এত আগে পড়ব বুঝতে পারিনি। সম্ভবত আমাকে ড্রাগ ডিলারদের মতো দেখাচ্ছিল। জনৈক মেয়ে পুলিশ এগিয়ে এসে নিখুঁত দ্রতায় বলল, তুমি কি আমার সঙ্গে একটু আসবে?
আমি গেলাম তার সঙ্গে।
তোমার বগলের এই ব্যাগে কি আছে?
আমি জানি না কি আছে।
তোমার ব্যাগ অথচ তুমি জানো না?
আমার স্ত্রী ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছে। কাজেই আমি জানি না কি আছে।
ব্যাগ খুলো।
খুললাম। প্রথম যে জিনিস বের হয়ে এলো তা হচ্ছে গোটা পঞ্চাশেকপ্যারাসিটামল ট্যাবলেট। আমার দীর্ঘদিনের সহচর–মাথাব্যথাকে বশে রাখার জন্যে তিন মাসের সাপ্লাই। মহিলা পুলিশের চোখে-মুখে আনন্দের ঝিলিক খেলে গেল। এই ঝিলিকের অর্থ হলো-পাওয়া গেছে। পাওয়া গেছে।
তুমি কি দয়া করে ব্যাখ্যা করবে এগুলি কি?