আমাদের দেশের মতো দরিদ্র কৃষক যেমন ভূমিহীন হচ্ছে এখানকার হতদরিদ্র আমেরিকানরা হচ্ছে গৃহহীন। একটি বাড়ি (নিজের বা ভাড়) এ দেশে টিকিয়ে রাখা কষ্টকর। গত নভেম্বর (৯০) নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের কথা বলি। নিউইয়র্কবাসী বৃদ্ধ এক আমেরিকানের স্বপ্নের কথা এই প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে। এই আমেরিকান বৃদ্ধ বয়সে সোস্যাল সিকিউরিটি থেকে চারশত সত্তর ডলার পান। চারশ’ উলার চলে যায় তার এক রুমের কামরার ভাড়া বাবদ। সত্তর ডলারে বাকি মাস টেনে নিতে হয়। রাত এবং দুপুরে খাবারের জন্যে একটা রেস্টুরেন্টে যান। রেস্টুরেন্টে খদ্দেরের উচ্ছিষ্ট খাবার তাকে দেয়া হয়। সেই ব্যবস্থা করা আছে। কাজেই দু’বেলা খাবারের খরচ বেঁচে যায়। তার একটা কফি মেশিন আছে। মাঝে মাঝে সেই কফি মেশিনে কফি বানিয়ে খান। ছেলে-মেয়েরা বড় হয়েছে। তাদের অনেকেরই ছেলেপুলে আছে। কারো সঙ্গেই এই বৃদ্ধের যোগাযোগ নেই। কারণ যোগাযোগ থাকলেই বিভিন্ন উপলক্ষে গিফট পাঠাতে হবে। সেই সামর্থ্য তার নেই। এই বৃদ্ধ তার বর্তমান জীবন নিয়ে সুখী কারণ তিনি গৃহহীন নন। একটা ছোট্টঘর তার আছে। শীতের রাতে যে ঘরে তিনি আরাম করে ঘুমুতে পারেন। পার্কের বেঞ্চিতে, বসে তাঁকে রাত কাটাতে হয় না। কাজেই তিনি ভাগ্যবান।
এক রাতে গুলতেকিনকে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছি। গ্রামোফোন রেকর্ডের দোকান দেখলেই থামছি, যদি ভালো এলপি পাই কিনে নেব। পাচ্ছি না। এলপি উঠে গেছে, তার জায়গায় এসেছে CD প্লেয়ার। এক দোকানে আমার পছন্দের কিছু ক্যাসেট পেলাম। কিংস্টোন ট্রায়ের Where have all the flowers gone… মন খারাপ করা গান। দু’জনে হাত ধরাধরি করে বাসায় ফিরছি। মনের ভেতরে গান বাজছে। শহরটা হয়ে গেছে অন্য রকম। এই রহস্যময় সময়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়াতে হলো–অত্যন্ত রূপবতী এক তরুণী তার শিশুপুত্রকে কোলে নিয়ে রাস্তার পাশে বসে আছে। তাদের সামনে কাঠ বোর্ডের একটি কাগজে লেখা–আমি এবং আমার শিশুপুত্র গৃহহীন। আপনার থলেতে কি কিছু ভাংতি পয়সা আছে?
মেয়েটির বয়স খুব বেশি হলে আঠারো-উনিশ। চোখ ধাঁধানো রূপ। তার ঘুমন্ত শিশুটিও মায়ের রূপের সবটুকু নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে। গুলতেকিন বিষ গলায় বলল, এ কি। সে পঁচ ডলারের একটি নোট নিয়ে এগিয়ে গেল। আমি দূরে দাঁড়িয়ে রইলাম। এমন রূপবতী একজনকে কেউ ভিক্ষা দিচ্ছে এই কষ্ট আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। কি দেখছি আজকের আমেরিকায় Where have all the flowers gone…
সানফ্রান্সিসকো থাকার কাল শেষ হয়েছে
সানফ্রান্সিসকো থাকার কাল শেষ হয়েছে, এখন যাচ্ছি নিউ অরলিন্স। গুলতেকিন আমার সঙ্গে যেতে পারছে না তার টিকিট পাইনি। সে চলে যাবে নিউ জার্সি। আমার জন্যে সেখানেই অপেক্ষা করবে। আমি নিউ অরলিন্সে এক সপ্তাহ কাটিয়ে চলে যাব তার কাছে।
আমি তাকে এয়ারপোর্টে তুলে দিতে এলাম। খুবই খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে–শেষ বিদায় দিতে এসেছি। আর দেখা হবে না। তার স্যুটকেস চেক ইন করে দিয়েছি–সে ঢুকবে সিকিউরিটি এলাকায়। খুব মন খারাপ করা মুহূর্ত। এই মুহর্তে হঠাৎ আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে সে বলল, আমার এদেশের একটা জিনিস খুব ভালো লাগে। বিদায় মুহূর্তে এদের স্বামী-স্ত্রীরা কি সুন্দর শালীন ভঙ্গিতে চুমু খায়। তোমার কি এই দৃশ্য দেখতে ভালো লাগে না?
আমি বললাম, হ্যাঁ ভালো লাগে।
আমার সব সময় মনের মধ্যে গোপন বাসনা ছিল
গুলতেকিন তার কথা শেষ করল না। ক্লান্ত ভঙ্গিতে সিকিউরিটি এলাকায় ঢুকে গেল। আমি মন খারাপ করে নিউ অরলিন্স রওনা হলাম। মন খারাপ হলেই আমার শরীর খারাপ করে। প্লেনে ওঠার পর পর মাথার যন্ত্রণা শুরু হলো। এক সময় দেখি নিঃশ্বাসে কষ্ট হচ্ছে।
নিউ অরলিন্সের ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারের চমৎকার একটি হোটেলের তিনতলায় এক সপ্তাহ কাটিয়ে দিলাম। একবারও ইচ্ছা করল না শহরটা কেমন ঘুরে দেখি। ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার ব্যাপারটা কি? কি বিশেষত্ব এই জায়গায় যে আমেরিকান সমস্ত প্রধান লেখকরাই তাদের জীবনের একটা বড় অংশ এখানে কাটিয়েছেন? কি আছে এখানে? হোটেলের বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারের আনন্দ ও উল্লাস ধ্বনি শুনি। পথে পথে হৈচৈ হচ্ছে। জ্যাজ সঙ্গীত হচ্ছে। নাচ হচ্ছে। প্রতিটি কাফে সারারাত খোলা। বার খোলা। মনে হয় এই পৃথিবীতে কোনো দুঃখ নেই।
আমি ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারের মতো মজাদার জায়গায় অসুস্থ হয়ে পড়ে আছি এই খবর রটে গেল। আমার সঙ্গী লেখকরা সব সময় খোঁজখবর নিতে আসছেন। পঁয়তাল্লিশ জন লেখকদের সবাই এখানে এসেছেন। তারা এক ধরনের দায়িত্ববোধ করছেন বাংলাদেশী ঔপন্যাসিকের কি হলো খোঁজ নেয়া। খুবই বিরক্তিকর অবস্থা। অবশ্য তাদের কাছ থেকে কিছু মজার মজার খবরও পাচ্ছি। যেমন ভারতীয় মহিলা কবি গগন গিল ডলার বাঁচানোর জন্যে আলজেরীয় নাট্যকারের সঙ্গে একটা রুম শেয়ার করছেন। একজন অল্পবয়স্কা ভারতীয় মহিলা এ রকম করবেন তা সহজভাবে গ্রহণ করতে একটু বোধহয় কষ্ট হয়। দেখলাম লেখকদের কেউই ব্যাপারটা সহজভাবে নিতে পারে নি।
পশ্চিম দেশীয় কোনো তরুণী শয্যাসঙ্গী হিসেবে অল্প পরিচিত কোনো পুরুষকে গ্রহণ করতে হয়তো আপত্তি করবে না। কিন্তু রাতে ঘুমুবার জন্যে একটি আলাদা ঘর চাইবে, প্রাইভেসি চাইবে। যাক এসব ক্ষুদ্রতা, অনা কথা বলি–নিউ অরলিন্সের হোটেল বরবনে রাত্রিবাস আমার একেবারে বৃথা গেল না–মে ফ্লাওয়ার এখানেই লেখা শুরু করলাম। শারীরিক অসুস্থতা ভুলে থাকার এই একটি চমৎকার উপায় লেখালেখিতে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলা। তাই করলাম। দরজা বন্ধ করে সারাদিন লেখার পর দেখি শরীরের ঘোর কেটে গেছে। ক্ষুধা বোধ হচ্ছে।