সে খুব আহত হলো বলে মনে হলো না। তার মানে আমার মতো আরো অনেকেই তাকে এই প্রশ্ন করেছে।
বিকেলে ক্লান্ত ও বিরক্ত হয়ে হোটেলে ফিরলাম। গুলতেকিন বলল, এখন কি করা যায়? আমি বললাম, খানিকক্ষণ ঝগড়া করলে কেমন হয়?
তার মানে?
বাসায় বাচ্চারা থাকে প্রাণখুলে ঝগড়া করা যায় না। এখানে চমৎকার নিরিবিলি। এসো দরজা বন্ধ করে প্রাণ খুলে ঝগড়া করে নেই।
পরদিন ভোরবেলা একজন এসকর্ট এসে উপস্থিত। দ্রলোক বিমানবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল। বিদেশী অতিথিদের নিজের সাথেই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সানফ্রান্সিসকো দেখান। তাকে নাকি ওয়াশিংটন থেকে বলা হয়েছে আমাদের সঙ্গ দেবার জন্যে। বেশ উৎসাহ নিয়েই আমরা তার সঙ্গে বের হলাম। তিনি বিশাল গাড়ি নিয়ে এসেছেন। বেশ হাসি-খুশি ধরনের মানুষ। সানফ্রান্সিসকোর নাড়ি নক্ষত্র জানেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই লক্ষ্য করলাম ভদ্রলোক কথা না বলে থাকতে পারেন না। অনর্গল কথা বলেন। গলার স্বরে কোনো উঠানামা নেই। কথা বলার সময় অন্যরা কি ভাবছে কি বলছে কিছুই লক্ষ করেন না। প্রথম শ্রেণীর একজন রবট। আমার মাথা ধরে গেল। এ কি যন্ত্রণা!
সবচে’ বিরক্তিকর ব্যাপার হলো ভদ্রলোক এমন ভঙ্গিতে কথা বলছেন যেন আমি আফ্রিকার গহিন অরণ্য থেকে এই প্রথম শার্ট-প্যান্ট গায়ে দিয়ে সভ্য সমাজে এসেছি। আমি এক ফাঁকে গুলতেকিনকে বললাম–এই ব্যাটাকে তো আর সহ্য করা যাচ্ছে না, কি করা যায় বলো তো?
সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, মাথার যন্ত্রণায় আমি মরে যাচ্ছি, কিছু একটা করো। আর পারছি না।
আমি এই বিপদ থেকে কি করে উদ্ধার পাওয়া যায় কিছুতেই বুঝতে পারছি। ভদ্রলোক এর মধ্যে কয়েক বারই বলেছেন তিনি আমাদের নিয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরবেন। সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে থাকলে বিরক্তিতেই মৃত্যু হওয়া বিচিত্র না। মুক্তির সুযোগ ভদ্রলোক নিজেই করে দিলেন। এক সময় বললেন, ভিয়েতনামের যুদ্ধে
আমি বি ফিফটি টু বিমান চালাতাম। দুবার আমাকে প্যারাস্যুট দিয়ে জাম্প করতে হয়েছিল। হোয়াট এন এক্সপেরিয়েন্স।
আমি বললাম, বি ফিফটি টু বিমান। তার মানে বোমারু বিমান?
ভিয়েতনামে ভারী ভারী বোমার বেশ কিছু তাহলে তুমি ফেলেছ।
হ্যাঁ। এটা হচ্ছে পার্ট অব দি গেম।
তাহলে তো একটা সমস্যা হলো।
কি সমস্যা?
তুমি অনেক নিরীহ মানুষের মৃত্যুর জন্যে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। আর এদিকে আমি একজন অনুভূতি প্রবণ লেখক। তোমার সঙ্গে থাকা তো আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। আমার মনের ওপর চাপ পড়ছে। তুমি কি দয়া করে আমাকে এবং আমার স্ত্রীকে হোটেলে পৌঁছে দেবে?
ভদ্রলোক চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে বললেন, তুমি হোটেলে ফিরে যেতে চাচ্ছ?
আমি সহজ গলায় বললাম, যা। আমাদের হোটেলে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে তোমার যদি অসুবিধা থাকে এখানেই নামিয়ে দাও। আমরা ট্যাক্সি ভাড়া করে চলে যাব।
না অসুবিধা নেই। চলো হোটেলে পৌঁছে দিচ্ছি।
গুলতেকিন বলল, তুমি এমন একটা কথা এ রকম কঠিনভাবে কি করে বললে?
আমি বললাম, আমেরিকানরা সরাসরি কথা বলা পছন্দ করে। ওরা যা বলার সরাসরি বলে। আমিও তাই করলাম।
সানফ্রান্সিসকো ঘুরে দেখার কাজ দু’জনে হাত ধরাধরি করে হেঁটে হেঁটেই সারলাম। খুব মজা লাগল চায়না টাউন দেখে। শহরের বিরাট একটা অংশ–সব চৈনিক। দোকানের সাইনবোর্ডগুলি পর্যন্ত চীনা ভাষায় লেখা। হাজার হাজার নাক চাপা লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবস্থা অনেকটা আমাদের দেশের হাটের মতো। দরদাম হচ্ছে। যার দাম শুরুতে কুড়ি ডলার হাঁকা হয়েছিল তা শেষ পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে সাত ডলারে। আমেরিকায় এই ব্যাপারটি অকল্পনীয়। দরদাম করার ব্যবস্থা আছে দেখে গুলতেকিন খুবই উৎসাহ পেয়ে গেল। তার এই উৎসাহের কারণে এক গাদা অপ্রয়োজনীয় জিনিস আমরা চায়না টাউন থেকে কিনে ফেললাম।
চায়না টাউনের এক অংশে আছে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যে আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা। ভেতরে কি হয় না হয় জানি না। বাইরে কিছু সাইন বোর্ড থেকে কিছুটা আঁট করা যায়। নমুনা দিচ্ছি
রেজিস প্লেস, অনিন্দ্য সুন্দরী নর্তকীরা নগ্ন গায়ে নৃত্য করবে। উপস্থিত অতিথিদের সবার টেবিলের উপরও তারা নাচবে।
মাত্র দশ ফুট দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সম্পূর্ণ নগ্ন তরুণীর সঙ্গে একান্ত কথা বলার সুযোগ। প্রতি মিনিট কথা বলার জন্যে এক ডলার পঞ্চাশ সেন্ট।
এই ব্যাপার আমেরিকার অনেক শহরে দেখেছি। এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো বাধা-নিষেধ হয়তো নেই। ফ্রি কান্ট্রিযার যা ইচ্ছা করতে পারে। যতদূর জানতাম নেভাদা স্ট্রেট ছাড়া অন্য কোনো স্ট্রেটে বেশ্যাবৃত্তির আইন সিদ্ধ নয় সানফ্রান্সিসকোতে সন্ধ্যার পর পথে অনেক নিশিকন্যাকেই দেখা গেল। উগ্র প্রসাধন, তার চেয়ে উগ্র পোশাক। একেক জনের চেহারা এত সুন্দর যে ইচ্ছা করে কাছে গিয়ে আশা ও আনন্দের দু’একটা কথা বলি। ওদের বুলি, পৃথিবীকে এই মুহূর্তে তাদের যত খারাপ লাগছে আসলে তত খারাপ নয়। এইসব নিশিকন্যাদের দেখলেই আমি নিজের ভেতর এক ধরনের বিষণ্ণতা অনুভব করি। এই বিষণ্ণতার জন্ম কোথায় আমি জানি না।
এই বিরাট শহরে প্রচুর গৃহহীন মানুষ দেখলাম। সাইন বোর্ড নিয়ে রাস্তায় মোড়ে মোড়ে বসে আছে।
আমি গৃহহীন আমাকে সাহায্য দাও।