সবার কথা শুনে শুনে আমারও ধারণা হলো ভুলই বুঝি করলাম। দুদিন দু’রাত ট্রেনে কাটানো সহজ কথা না। অথচ শুরুতে ভেবেছি চারপাশের দৃশা দেখতে দেখতে যাব। ট্রেনের কামরা থেকে আমেরিকার একটা বড় অংশ দেখা হয়ে যাবে। গুলতেকিন বলল, আমেরিকান ট্রেনের জানালা খুলা যায়?
আমি বললাম, মনে হয় না। শীতের সময় জানালা খুলবে কি ভাবে?
তাহলে আমরা শুধু শুধু ট্রেনে যাচ্ছি কেন? বন্ধু জানালার ভেতর দিয়ে কি দেখব? কাচের ভেতর দিয়ে কিছু দেখতে আমার ভালো লাগে না।
আমারও ভালো লাগে না। কিন্তু উপায় নেই, টিকিট কাটা হয়ে গেছে।
দয়া করে স্বীকার করো যে আবার একটা ভুল করেছ। তোমার কি উচিত এইসব পরিকল্পনা করার আগে দশ জনের সঙ্গে কথা বলে জেনে নেয়া?
খুবই উচিত?
যথা সময়ে আমরা ট্রেনে উঠলাম। গুলতেকিনের গম্ভীর মুখ ট্রেনে উঠেই পাল্টে গেল। সে পরপর তিন বার বলল–চমৎকার!
এ্যামট্রেক দোতলা ট্রেন। একতলায় টয়লেট, মালপত্র রাখার জায়গা। দু’তলায় বসার ব্যবস্থা। ট্রেনের দুটি বিশাল কামরা হলো অবজারভেশন ডেক। পুরো দেয়াল কাচের। ভেতরে রিভলবিং চেয়ার। এখানে বসে চারপাশের দৃশ্য দেখতে দেখতে যাওয়া যায়।
জোসনা রাত। আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। আমরা দুজন অবজারভেশন ডেকে বসে আছি। প্রেইরি প্রান্তর ভেদ করে ট্রেন ছুটে চলছে। তিনটি ইঞ্জিন ট্রেনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গুলতেকিন বলল, আমার মনে হচ্ছে এ জীবনে মনে রাখার মতো যা কিছু অভিজ্ঞতা আমার আছে–এই ট্রেন ভ্রমণ হবে তার একটি।
আমি বললাম, আমারো তাই ধারণা।
সে লাজুক স্বরে বলল–আমি লক্ষ্য করেছি মাঝে মাঝে তুমি কোনো রকম চিন্তাভাবনা না করে একটা কাণ্ড করে বসে। যার ফল আবার কি করে কি করে যেন খুব ভালো হয়ে যায়। ভাগ্যিস তুমি কারো কথা না শুনে ট্রেনের টিকিট কেটেছিলে।
ট্রেন ঝড়ের গতিতে ছুটে চলেছে। কামরায় গাড়ি ভরা ঘুম রজনী নিঝুম। আমরা দুজনে চুপচাপ বসে আছি। চোখের সামনে আদিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। মাঠের উপর ফিনিক ফোটা জোছনা।
ভোরবেলা দৃশ্যটাই বদলে গেল। ট্রেন ঢুকল রকি পর্বতমালায়। পাহাড় কেটে কেটে ট্রেন লাইন বসানো হয়েছে। কখনো ট্রেন ঢুকছে সুরঙ্গে কখনো ট্রেন গভীর গিরিপর্বত পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। নিচের দিকে তাকালে মাথা ঘুরে যায়। পাহাড়গুলিরইবা কি শোভা। মাথায় বরফের চাদর। পাহাড়ের শরীরে পাইন গাছের চাদর।
ট্রেন লাইনের পাশে পাশেই আছে পাহাড়ি কলারাডো নদী। সে দু’শ সত্তর মাইল আমাদের পাশে পাশে রইল। কি স্বচ্ছ তার পানি। ঘন নীল আকাশের ছায়া পড়েছে তার গায়ে। পাহাড় ভেঙে নদী চলছে আপন গতিতে। আমার কেবলি মনে হতে লাগল, ইস যদি ঐ পানি ছুঁয়ে দেখতে পারতাম।
মাঝে মাঝে পাহাড়ের গায়ে বাড়িঘর দেখা যাচ্ছে। একটা লাল ইটের বাড়ি দেখলাম। ছবির বাড়িও এত সুন্দর থাকে না। আকাশের মেঘ ঐ বাড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাড়ির উঠোনে কালো রঙের একটা ঘোড়া। লাল স্কার্ফ মাথায় জড়িয়ে বাচ্চা একটা মেয়ে দৌড়াচ্ছে। আহা তারা কি সুখেই না আছে! যদি এমন একটা বাড়ি আমার থাকত!
অন্ধকার গুহা থেকে বের হয়ে ট্রেন একবার চলে এল ফুলে ফুলে ভরা এক ভ্যালিতে–খুব পরিচিত ফুল, কাশ ফুল। চেনা ফুল অচেনা জায়গায়। কিছু নাম না জানা ফুলও আছে! কি ভালোই না লাগছে দেখতে।
I offen see flowers from a passing car
That are gone before I can tell what they are.
I want to get out of the train and go back
To see what they were beside the track…
Heaven gives its glimses only to those
Not in position to look too close
(Robert Frost)
সানফ্রান্সিসকোতে আমাদের থাকার জায়গা ডাউন টাউনের বড় একটা হোটেলে। হোটেল বেডফোর্ড। চায়না টাউনের পাশে আকাশ ছোঁয়া বাড়ি। ঘুরে বেড়ানোয় গুলতেকিনের খুব আগ্রহ। সে ট্যুরিস্টদের কাগজপত্র ঘেঁটে নানান জায়গা বের করছে যা আমরা দেখব।
ফিশারম্যান ওয়ারফ
গোল্ডেন গেট
মুর উডস
নাপা ভ্যালি
কুঁকেড স্ট্রিট
ফিশারম্যান ওয়ারফ প্রথম দেখতে গেলাম। আমেরিকান জেলে পল্লী। আহামরি কিছু নয়–বাংলাদেশের সদরঘাট। অসংখ্য ছোট ছোট মাছ ধরার বোট। খাবারের দোকান-এর বেশি কিছু না। ট্যুরিস্টরা মহানন্দে তাই দেখছে এবং পটাপট ছবি তুলছে। আমি মুগ্ধ এবং বিস্মিত হবার কিছুই পাচ্ছি না। অবশ্যি দুটি সিল মাছ কিছুক্ষণ পরপর মাথা তুলে বিকট শব্দ করছে। এই দৃশ্যটি খানিকটা আকৃষ্ট করল।
একটি ছবি তোলার পর সেই দৃশ্যের আবেদনও ফুরিয়ে গেল। আমি বললাম, গুলতেকিন হোটেলে ফিরে গেলে কেমন হয়? সে অত্যন্ত আহত হলো বলে মনে হলো। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, হোটেলে ফিরে যাব মানে? হোটেলেই যদি বসে থাকবে তাহলে বেড়াতে আসার মানে কি?।
আমি তো আর দেখার মতো কিছু পাচ্ছি না।
তুমি দেখার মতো কিছু পাচ্ছ না তাহলে হাজার হাজার ট্যুরিস্ট কি দেখছে?
টুরিস্টরা কি দেখছে সেও এক রহস্য। হাজার হাজার টুরিস্ট ক্যামেরা কাঁধে মুগ্ধ চোখে ঘুরছে। তাদের দেখে মনে হচ্ছে বিস্ময় ও আনন্দে তারা অভিভূত। আমি অবাক হয়ে ভাবছি আনন্দ পাবার চমৎকার অভিনয় তারা কার জন্য করছে? নিজের জন্যে? কেন করছে?
গুলতেকিনকে খুশি করার জন্যে একটা ওয়াক্স মিউজিয়ামে ঢুকলাম। লন্ডনের মাদাম তুষোর ওয়াক্স মিউজিয়ামের নামডাক শুনেছি দেখি এদেরটা কেমন। টিকিটের দাম ষোল ডলার খুব খারাপ হবার কথা না। মাবুদে এলাহী, কিছুই নেই ভেতরে। ক্লিওপেট্রা নাম দিয়ে যে মূর্তি বানিয়ে রেখেছে তাকে দেখাচ্ছে ফর্সা বাঁদরের মতো। এক জায়গায় দেখলাম প্রেসিডেন্ট বুশকে বানিয়েছে, দেখাচ্ছে কংকালের মতো। হাঁ করে আছে। মনে হচ্ছে কামড় দিতে আসছে। আমি মিউজিয়ামের একজন কর্মকর্তাকে বিনীত ভঙ্গিতে বললাম–এটা কি প্রেসিডেন্ট বুশের কংকাল?