ভালোই আছে। তুমি কেমন আছ?
ভালো।
তুমি চিঠিতে লিখেছিলে বিশাল দোতলা বাড়িতে থাকি। এই বুঝি তোমার বিশাল দোতলা বাড়ি?
তোমার কাছে বিশাল মনে হচ্ছে না?
হ্যাঁ বিশাল। তবে তোমার চিঠি পড়ে আমি অন্য রকম কল্পনা করে রেখেছিলাম। তুমি লিখেছিলে তোমার সঙ্গে ফিলিপাইনের এক ঔপন্যাসিক থাকেন। উনি কোথায়?
উনি দু’দিনের জন্যে আমানা কলোনিতে গেছেন। চলে আসবেন। তুমি হাত-মুখ ধুয়ে বিশ্রাম করো। আমি রান্না করছি।
তুমি রান্না করবে?
হ্যাঁ তুমি এখন আমার অতিথি।
ভাত, গোশত এবং ডাল রান্না করলাম। ভাত গলে গিয়ে জাউয়ের মতো হয়ে গেল। গোশত পুরোপুরি সিদ্ধ হলো না। ডালে লবণ বেশি হয়ে গেল। তাতে কি? সময় এবং পরিস্থিতিতে অখ্যাদ্য খাবারও অমৃতের মতো লাগে। আমি হাই ভি স্টোর থেকে এক প্যাকেট আইসক্রিম এবং দুটো মোমবাতি কিনে নিয়ে এলাম। হোক একটা ক্যান্ডল লাইট ডিনার।
খেতে কেমন হয়েছে গুলতেকিন?
চমৎকার।
আমি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বললাম, আচ্ছা গুলতেকিন আমাকে কি তোমার এই মুহূর্তে অপরিচিত কোনো যুবকের মতো লাগছে?
গুলতেকিন বলল, অপরিচিত যুবকের মতো লাগবে কেন? তুমি মাঝে মাঝে কি সব অদ্ভুত কথা যে বলো!
গুলতেকিনকে ঘুরে ঘুরে দেখাব এমন কিছু আইওয়াতে নেই। বড় বড় শপিং মল অবশ্যি আছে, সে সব তো আমেরিকার সব স্টেটেই আছে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কয়েকটি চমৎকার মিউজিয়াম আছে। সেখানে যেতে ইচ্ছা করছে না। দেশের বাইরে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে দূরে থাকতে চেষ্টা করি।
কিছু দেখার নেই বলে ঘরে চুপচাপ বসে থাকার অর্থ হয় না। পরদিন তাকে নিয়ে বের হলাম। সে বলল, আমরা কি দেখতে যাচ্ছি?
সেইন্ট জোসেফ সিমেটিয়ারি।
কবরখানা?
হ্যাঁ কবরখানা।
তের হাজার মাইল দূর থেকে কবরখানা দেখতে এসেছি?
চলো না। তোমার ভালো লাগবে।
তোমার রুচির কোনো আগামাথা আমি এখনো বুঝতে পারলাম না। আশ্চর্য।
চলো আগে যাই তারপর যা বলবে শুনব। আমার ধারণা তোমার ভালো লাগবেই।
তার ভালো লাগল। সে মুগ্ধ বিস্ময়ে বলল, দেখো দেখো প্রতিটি কবরের সামনে, ফুলের গুচ্ছ। এরা কি রোজ এসে ফুল দিয়ে যায়?
যায় নিশ্চয়ই। নয়তো ফুল আসবে কোত্থেকে? কিংবা হয়তো কোনো ফুলের দোকানকে বলে দিয়েছে তারা প্রতিদিন ফুল দিয়ে যাচ্ছে।
নিশ্চয়ই খুব খরচান্ত ব্যাপার। রোষ্ট্র একগুচ্ছ ফুল।
গুলতেকিনের এই কথায় খটকা লাগল। তাই তো এমন খরচান্ত ব্যাপারে এরা যাবে? মৃতদের প্রতি তাদের কি এতই মমতা? বাবা-মা বুড়ো হলে যারা তাদের ফেলে দিয়ে আসে ওল্ড হোমে…। আমি এগিয়ে গেলাম এবং গভীর দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম সবই প্লাস্টিকের ফুল। খুবই সুন্দর আসল-নকলে কোনো ভেদ নেই কিন্তু প্লাস্টিকের তৈরি। একবার এসে রেখে গেছে বছরের পর বছর অবিকৃত আছে। মন খুব খারাপ হয়ে গেল। এই চমৎকার ফুলে ফুলে সাজানো কবরখানা আসলে মেকি ভালোবাসায় ভরা। এরা যখন কোনো মেয়ের সঙ্গে ডেট করতে যায় তখন হাতে এক গুচ্ছ ফুল নিয়ে যায়। সেই ফুল আসল ফুল। প্লাস্টিকের ফুল নয় কিন্তু মৃতদেহের বেলায় কেন প্লাস্টিকের ফুল? আমার মনটাই খারাপ হয়ে গেল।
পনেরো দিনের একটি ট্যুর প্রোগ্রাম
পনেরো দিনের একটি ট্যুর প্রোগ্রামের শেষে লেখক সম্মেলনের ইতি। টুর প্রোগ্রামটি চমৎকার। এই পনেরো দিনে লেখকরা যে যেখানে যেতে চান সেই ব্যবস্থা আমেরিকান ইনফরমেশন সার্ভিস করবে। টিকিট কেটে দেবে, আগেভাগে হোটেলের ব্যবস্থা করে রাখবে। মোটামুটি রাজকীয় ব্যবস্থা বলা যেতে পারে।
আমি যেসব জায়গায় যেতে চেয়েছি সেগুলি হচ্ছে সানফ্রান্সিসকো, নিউ অর্লিপ এবং নিউইয়র্ক। সানফ্রান্সিসকো পছন্দ করার কারণ ঔপন্যাসিক স্টেইনবেক সানফ্রান্সিসকোর মানুষ। তার বেশিরভাগ উপন্যাসের পটভূমি সেলিনাস ভেলি। নিউ অর্লিঙ্গ পছন্দ করার কারণ সেখানকার ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টার। ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারে উইলিয়াম ফকনার প্রথম উপন্যাস লেখা শুরু করেন। ও হেনরির লেখক জীবনও শুরু হয় এইখানে। টেনেসি উইলিয়মসের বিখ্যাত লেখা A street car named desire লেখা হয় নিউ অর্লিন্সের ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারে। এই ফ্রেঞ্চ কোয়ার্টারেই আংকেল টমস কেবিন উপন্যাসটির অকসান হয়। কাজেই অতি বিখ্যাত এই জায়গাটি সম্পর্কে আমার কৌতূহল হওয়া স্বাভাবিক।
মুশকিল হলো গুলতেকিনকে নিয়ে। তার টিকিট কাটতে হবে আমাকে। সেটা কোনো সমস্যা নয়, সমস্যা হলো টিকিট পাওয়া নিয়ে। অনেক কষ্টে আইওয়া থেকে সানফ্রান্সিসকোর ট্রেনের টিকিট পাওয়া গেল। ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায়। আমেরিকানরা ট্রেনের ভক্ত নয়। সমস্যা হলো বিমানের টিকিট নিয়ে তার জন্যে বাকি টিকিট পাওয়া গেল না। ঠিক করলাম সে সানফ্রান্সিসকোয় পাঁচ দিন থেকে চলে যাবে নিউজার্সিতে ওখানকার টিকিট পাওয়া যাচ্ছে। সে সেখানেই আমার জন্যে অপেক্ষা করবে। আমি আমার প্রোগ্রাম শেষ করে তার সঙ্গে যোগ দেব এবং তাকে নিয়ে ওয়াশিংটন ডিসিতে বেড়াতে যাব।
এই পরিকল্পনা তার যে খুব পছন্দ হলো তা না কিন্তু এর বেশি তো কিছু করার নেই।
আমার ভ্রমণ পরিকল্পনা শুধু তার না অনেকেরই পছন্দ হলো না। যেই শুনে সেই বলে তুমি দু’হাজার মাইল রাস্তা যাবে ট্রেনে করে? তোমার কি মাথাটা খারাপ হলো? আমেরিকান ট্রেনের সেই রমরমা এখন নেই। এমট্রেকের নাভিশ্বাস উঠেছে। দু’দিন দু’রাত ট্রেনে থেকে বিরক্তিতেই তুমি মারা যাবে। খুবই অব্যবস্থা।