একদিন আমাদের বাড়ির লনে আসর বসল। বার্বিকিউ হচ্ছে, বিয়ার খাওয়া হচ্ছে। এর মধ্যেই গল্প পাঠের আসর। পাঠ করা হবে বাংলাদেশের গল্প। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিনয় কলায় পড়াশোনা করছে এমন একজনকে ঠিক করা হলো আমার ১৯৭১ উপন্যাসটির ইংরেজি অনুবাদ পড়ে শোনানোর জন্যে। সম্ভবত আমার পড়ার ওপর ওদের আস্থা নেই। উপন্যাসটির অনুবাদ করেছেন ঢাকা কলেজের ইংরেজি ভাষার অধ্যাপিকা রহিমা খাতুন। খুব সুন্দর অনুবাদ। পাঠও খুব চমৎকার হলো। এত ভালো হবে আমি নিজেও ভাবিনি। আমি অবশ্যি সব সময়ই নিজের লেখার ভক্ত। আজ যেন আরো ভালো লাগছে।
সিকাট তার একটি এক অঙ্কের নাটক অভিনয় করে দেখালেন। একটিই চরিত্র। কুড়ি মিনিটের অভিনয়। মূল নাটক টেগালোগ ভাষায় লেখা–অভিনীত হলো ইংরেজি ভাষায়। সবাই খুব আগ্রহ ও আনন্দ নিয়ে দেখলেন। পলিটিক্যাল নাটক। লেখা হয়েছে মার্কোসের সময়কে বিদ্রুপ করে।
সিকাট অভিনয় শেষে মার্কোসের আমলের নৃশংসতার একটি গল্পও বললেন ফিলিপাইনে একবার একটি আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান হবে। বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতা। মার্কোস হুকুম দিলেন নতুন একটি ভবন তৈরি করতে হবে এবং তা করতে হবে এক মাসের মধ্যে। ভবন তৈরি শুরু হলো–দিনরাত কাজ হচ্ছে। এমন সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটল। ছাদ ধসে পড়ল। পঞ্চাশ জনের মতো শ্রমিক আটকা পড়ে গেল। বেশিরভাগই মারা গেল তবে কিছু আহত হয়েও ভেতরে রইল। ওদের উদ্ধার করতে হলে আরো দিন সাতেক লাগবে। অথচ হাতে সময় নেই। মার্কোস হুকুম দিলেন উদ্ধারের দরকার নেই। যথাসময় কাজ শেষ হওয়া চাই। হলোও তাই।
শিউরে উঠতে হয় গল্প শুনে। আমরা কোথায় আছি? কোন জগতে বাস করছি? এই কি আমাদের সভ্যতা? আমরা মধ্যযুগীয় নৃশংসতার কথা বলি–এই যুগের নৃশংসতা কি মধ্যযুগের চেয়ে কিছু কম? মনে তো হয় না।
পার্টি পুরোদমে চলছে। বার্বিকিউ হচ্ছে, বিয়ার খাওয়া হচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশের লেখকই কি পানীয়ের প্রতি বিশেষ মমতা পোষণ করেন। অবস্থাদৃষ্টে তাই মনে হচ্ছে। ব্রাজিলের লেখক রেইমুন্ডু ক্যারেরো পুরো মাতাল হয়ে পড়েছেন বলে মনে হলো। আবোলতাবোল বকছেন এবং লাফালাফি করছেন। খানিকক্ষণ পর পর আমার দিকে তাকিয়ে হুংকার দিচ্ছেন–Bangladesh! Bangladesh প্যালেস্টাইনের মহিলা কবিকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন। সেই বেচারির পুরো ব্যাপারটি হেসে উড়িয়ে দেয়া ছাড়া কিছু করার রইল না। অন্য মহিলারাও খানিকটা শংকিত বোধ করছেন।
ভারতীয় কবি গগন গিল আমার কাছে এগিয়ে এসে শুকনো গলায় বললেন, হুমায়ুন খুব বিপদে পড়েছি।
কি বিপদ?
ঐ চেক কবি আমাকে ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে। কি করব বুঝতে পারছি।’
কি ঝামেলায় ফেলেছে?
ও বলছে তোমার ড্রেস অসম্ভব সুন্দর। আমাকে তুমি এরকম একটা ড্রেস পরিয়ে দাও। ঐ ড্রেস পরে আমি পরবর্তী পার্টিতে যাব। আমি তাকে বলেছি এই ড্রেসটার নাম শাড়ি, এটা মেয়েদের গোষাক। তুমি পুরুষ মানুষ। তোমার জন্যে নয়। সে মানছে না। সে বলছে–তোমরা মেয়েরা তো আমাদের শার্ট-প্যান্ট পরছ। আমরা তোমাদের একটা ড্রেস পরলে অসুবিধা কি? তা ছাড়া পুরুষ-রমণীর কোনো ভেদাভেদ আমার কাছে নেই।’
এই অবস্থা হলে ওকে একটা শাড়ি পরিয়ে ছেড়ে দাও। প্রচুর ছবি তুলে দেশে নিয়ে যাও। ছবি দেখে সবাই মজা পাবে।
তুমি কি সত্যি তাই করতে বলছ?
হ্যাঁ বলছি।
আমি নিজে কখনো মনে করি না একজন লেখক অন্য দশজনের চেয়ে আলাদা কিছু। কোনো লেখকই হয়তো তা মনে করেন না তবে নিজেদের খানিকটা আলাদা করে দেখানোর ইচ্ছা তাদের থাকে না তাও বোধ হয় সত্যি না। সচেতনভাবে না হলেও অবচেতন একটি বাসনা বোধ হয় থেকেই যায়। নিজেকে আলাদা করে দেখানোর এই প্রবণতাটি প্রকাশ পায় লম্বা চুলে, লম্বা দাড়িতে কিংবা বিচিত্র পোশাক-আশাকে। রবীন্দ্রনাথের মতো প্রতিভাধর মানুষকেও আলখাল্লা বানিয়ে পরতে হয়েছে।
প্রসঙ্গক্রমে আর্জেন্টিনার লেখক এনরিখে বুটির কথা বলি। চমৎকার মানুষ। মাথা ভর্তি ঘনকালো চুল। হঠাৎ এক সকালে দেখি পুরো মাথা কামিয়ে বসে আছেন। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করতেই বললেন, কিছু করার ছিল না। ঘরে বসে বোর হচ্ছিলাম। কাজেই মাথাটা কামিয়ে ফেললাম।
দেখলাম তিনি মাথা পেতে বসে আছেন, অন্য লেখকরা কামানো মাথায় হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন। এনরিখে বুটি বিমলানন্দে হাসছেন। পুরো ব্যাপারটায় মনে হলো তিনি খুব মজা পাচ্ছেন।
রাতে মে ফ্লাওয়ারের হল ঘরে আমার লেখা ধারাবাহিক টিভি নাটক অয়োময়ের একটি পর্ব। (চতুর্থ পর্ব, এই পাগলকে নৌকায় করে গ্রামের বাইরে ফেলে দিয়ে আসা হয়) দেখানো হলো। প্রজেকশন টিভির মাধ্যমে বড় পর্দায় সিনেমার মতো করে দেখা। সাব টাইটেল নেই, কাহিনী বোঝা খুব মুশকিল। অবশ্যি এটা বক্তৃতা এবং লিখিতভাবে কি হচ্ছে না হচ্ছে আগেই বলে দেয়া হয়েছে তবু মনে হলো অধিকাংশ দর্শক বেশ কনফিউজড। অনেকেই দুটি বৌ নিয়ে অবাক। দুজন বৌ কি করে থাকে? পাগলকে চিকিৎসা না করে গ্রামের বাইরে ফেলে দিয়ে আসার ব্যাপার কি সত্যি ঘটে?
কিছু আমেরিকান ছাত্র–যারা লেখক নয় তবে ক্রিয়েটিভ রাইটিং-এর ছাত্র, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোর্স নিচ্ছে কি করে লেখক হওয়া যায় তারা অয়োময়ে মির্জার দুই বৌ নিয়ে আমাকে কঠিন আক্রমণ করল। তাদের ধারণা এটা এসেছে মুসলিম কালচার থেকে। ইসলাম ধর্মে চার বিয়ের বিধান–কাজেই এই ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ে বহু বিবাহ ঢুকে পড়েছে। উঠে এসেছে তাদের সাহিত্যে। শেষ পর্যন্ত বিরক্ত হয়ে বললাম–আমার তো মনে হয় প্রকৃতিই বহু বিবাহ সমর্থন করে। তাকিয়ে দেখো জীব জগতের দিকে একটি পুরুষ নেকড়ে অনেক ক’টি মেয়ে নেকড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, বন্য মহিষ, বাইসন, সিংহ, শেয়াল সবার বেলায় এই নিয়ম। মানুষ তো এক অর্থে পশু, তার বেলাতেই হবে না কেন? প্রকৃতি এটী চায় বলেই মেয়েদের সংখ্যা পুরুষদের চেয়ে বেশি। কূট তর্কে হারিয়ে দিলাম ঠিকই কিন্তু আমি তো