ত্রিপুরেশ্বরী মন্দিরের একটা বিষয় আমার সফরসঙ্গীদের, বিশেষ করে মহিলাদের, খুব আকর্ষণ করল। সেখানে একটা বাচ্চার অন্নপ্রাশন উৎসব হচ্ছিল। বর্ণাঢ্য উৎসব। তারা উৎসবের সঙ্গে মিশে গেল। পুরোহিতের অনুমতি নিয়ে নিজেরাই আনন্দঘন্টা বাজাতে লাগল।
উৎসবের মধ্যেই জানা গেল, পাশেই ইচ্ছাপূরণ দিঘি বলে এক দিঘি। দিঘি ভর্তি মাছ। মাছকে খাবার খাওয়ালে তাদের গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে দিলে মনের ইচ্ছা পূরণ হয়। মেয়েরা অন্নপ্রাশন উৎসব ছেড়ে রওনা হলো ইচ্ছেপূরণ দিঘির দিকে।
এই অঞ্চলেই নাকি ভারতবর্ষের সবচে’ ভালো প্যাড়া পাওয়া যায়। দুশ বছর ধরে মিষ্টির কারিগররা এই প্যাড়া বানাচ্ছেন। আমি গেলাম প্যাড়া কিনতে। ভারতবর্ষের মন্দিরগুলির সঙ্গে প্যাড়ার কি কোনো সম্পর্ক আছে? যেখানে মন্দির সেখানেই প্যাড়া। দেবতাদের ভোগ হিসেবে মিষ্টান্ন দেওয়া হয়। প্যাড়া কি দেবতাদের পছন্দের মিষ্টান্ন?
পাড়ার একটা টুকরো ভেঙে মুখে দিলাম-যেমন গন্ধ তেমন স্বাদ। আমাদের মধ্যে প্যাড়া কেনার ধুম পড়ে গেল।
আমি কবি রাতুলকে প্রশ্ন করলাম, আপনার কি ধারণা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এখানকার প্যাড়া খেয়েছেন?
রাতুল প্রশ্নের জবাব দিতে পারলেন না। আমার নিজের ধারণা খেয়েছেন। ভালো জিনিসের স্বাদ তিনি গ্রহণ করবেন না তা হয় না। যদিও তার সমগ্র রচনার তিনি শারীরিক আনন্দের বিষয়টিকে তেমন গুরুত্ব দেন নি। তাঁর রচনায় মানসিক আনন্দের বিষয়টিই প্রধান। শরীর গৌণ। তাঁর বিপুল সাহিত্যকর্মে যৌনতার বিষয়টি অনুপস্থিত বললেই হয়। হৈমন্তী গল্পে একবার লিখলেন-”তখন তাহার শরীর জাগিয়া উঠিল। এই পর্যন্ত লিখেই চুপ। তার কাছে দেহ মনের আশ্রয় ছাড়া কিছু না। নারীদের দিকে তাকালে পুরুষদের নানা সমস্যা হয়। রবীন্দ্রনাথের সমস্যা অন্যরকম–
ওই দেহ-পানে চেয়ে পড়ে মোর
মনে যেন কত শত পূৰ্বজনমের স্মৃতি।
সহস্র হারানো সুখ আছে ও নয়নে,
জন্মজন্মান্তের যেন বসন্তের গীতি।
[স্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর]
.
কালো বুদ্ধিজীবী
বুদ্ধিজীবীরা শাদা-কালো হন না। তাদের জীবিকা বুদ্ধি। বুদ্ধি বর্ণহীন। তবে আমাদের ভ্রমণের একজন প্রধানসঙ্গী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক শফি আহমেদকে আমি কালো বুদ্ধিজীবী ডেকে আনন্দ পাই।
চিল আকাশে উড়ে, তার দৃষ্টি থাকে স্থলে। শফি আহমেদ বাংলাদেশে বাস করেন, কিন্তু তার হৃদয় পড়ে থাকে আগরতলায়। আগরতলার প্রতিটি গাছ, প্রতিটি পাথর তিনি চেনেন। আগরতলা সম্পর্কে কেউ সামান্যতম মন্দ কথা বললে তিনি সার্টের হাতা গুটিয়ে মারতে যান।
এই সদানন্দ চিরকুমার মানুষটি আমাকে মুক্তিযুদ্ধের সময় আগরতলার মহান ভূমিকার কথা কী সুন্দর করেই না বললেন! মুক্তিযোদ্ধারা কোথায় থাকত, কোথায় ছিল ফিল্ড হাসপাতাল, সব ঘুরে ঘুরে দেখালেন।
বেড়াতে গেলে আমি কখনো ইউনিভার্সিটি বা কলেজ দেখতে যাই না। কালো বুদ্ধিজীবী আমাকে জোর করে নিয়ে গেলেন ব্লগরতলার এমবিবি কলেজে। কারণ কী? কারণ একটাই, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই কলেজের একটা ভূমিকা আছে। কলেজটা ছিল শরণার্থী শিবির। কাজেই আমাকে দেখতে হবে।
শুনতে পাচ্ছি শফি আহমেদ সাহেব বলেছেন, মৃত্যুর পর তার কবর যেন হয় আগরতলায়। শফি সাহেবের বন্ধুবান্ধবরা চিন্তিত। ডেডবডি নিয়ে এতদূর যাওয়া সহজ ব্যাপার না।
.
চখাচখি
আমাদের এবারের ভ্ৰমণ চখাচখি ভ্রমণ সবাই জোড়ায় জোড়ায় এসেছে। দেশের বাইরে পা দিলে চখাচখি ভাবের বৃদ্ধি ঘটে। আমাদের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। স্ত্রীরা স্বামীদের নিয়ে নানান আহ্লাদী করছে। স্বামীরা প্রতিটি আল্লাদীকে গুরুত্ব দিচ্ছে। খুবই চেষ্টা করছে প্রেমপূর্ণ নয়নে স্ত্রীর দিকে তাকাতে। মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতে। মাজহার এবং কমল দু’জনকেই দেখলাম স্ত্রীর মুখে তুলে পাড়া খাওয়াচ্ছে। স্ত্রীরাও এমন ভাব করছে যেন সারাজীবন তারা এভাবেই মিষ্টি খেয়ে এসেছে। এটা নতুন কিছু না।
চখাচখিদের মধ্যমণি অন্যদিন পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক নাসের এবং নাসের পত্নী তামান্না! এটা তাদের হানিমুন ট্রিপ। কিছুদিন আগেই বিয়ে হয়েছে। তামান্নার হাতের মেহেদির দাগ তখনো ম্লান হয় নি।
আমরা কত না জায়গায় ঘুরলাম, কত কিছু দেখলাম, এই দু’জন কিছুই দেখল না। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইল।
চখাচখি গ্রুপ থেকে বাদ পড়েছে মিলন ও আলমগীর রহমান। তার স্ত্রীদের দেশে ফেলে গেছে। সবাই জোড়া বেঁধে ঘুরছে, মিলন-আলমগীরও জোড়া বেঁধে ঘুরছে। দু’জনের মুখই গম্ভীর। দুজনই দু’জনের উপর মহাবিরক্ত। ভদ্রতার খাতিরে কেউ বিরক্তি প্রকাশ করতে পারছে না। মজার ব্যাপার।
সবচে’ আনন্দ লাগল আর্কিটেক্ট করিম এবং তার স্ত্রী স্নিগ্ধাকে দেখে। স্নিগ্ধা সারাক্ষণ স্বামীর হাত ধরে আছে। করিমের অতি সাধারণ রসিকতায় হেসে ভেঙে পড়ছে এবং রাগ করে বলছে, তুমি এত হাসাও কেন? ছিঃ! দুষ্টু!
করিমের গানের গলা ভালো। যে-কোনো বাংলা হিন্দি গানের প্রথম চার লাইন সে শুদ্ধ সুরে গাইতে পারে। করিম তার এই ক্ষমতাও কাজে লাগাচ্ছে, স্নিগ্ধার প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে গানে।
শাওন একসময় আমাকে বলল, দেখ করিম চাচা স্ত্রীকে নিয়ে কত আনন্দ করছেন, আর তুমি গম্ভীর হয়ে বসে আছ।