তখন আমরা পুঁটলাপুঁটলি নিয়ে বাসে উঠে বসেছি। এক্ষুনি বাস ছাড়বে।
তারা বললেন, আমরা বাসের সামনে শুয়ে থাকব, দেখি আপনারা কীভাবে যান।
.
টুরিস্ট, না লেখক?
কবি-লেখকদের সম্মিলিত হৈচৈয়ের ভেতর পড়ব এমন চিন্তা আমার মনেও ছিল না। আমার কল্পনায় ছিল বন্ধুবান্ধব নিয়ে টুরিস্টের চোখে রবীন্দ্রনাথের প্রিয়ভূমি দেখব। সেটা সম্ভব হলো না। আমাকে নিয়ে তাদের আগ্রহ দেখেও কিছুটা বিব্রত এবং বিচলিত বোধ করলাম। এত পরিচিত ত্রিপুরায় আমার থাকার কথা না। বাংলাদেশের গল্প-উপনাস ত্রিপুরায় খুব যে পাওয়া যায় তাও না। টিভি চ্যানেলগুলি দেখা যায়। আমার পরিচিতির সেটা কি একটা কারণ হতে পারে? অনেক বছর ধরে দেশ পত্রিকার শারদীয় সংখ্যায় উপন্যাস লিখি, সেটা কি একটা কারণ? হিসাব মিলাতে পারছি না।
প্রথম রাতেই যেতে হলো বইমেলায়। ভেবেছিলাম ছোট্ট ঘরোয়া ধরনের বইমেলা। গিয়ে দেখি হুলস্থূল আয়োজন। বিশাল জায়গা নিয়ে উৎসব মুখরিত অঙ্গন। দেখেই মন ভালো হয়ে গেল। প্রতিটি দোকান সাজানো, সুশৃঙ্খল দর্শকের সার। মেলার বাইরে বড় বড় ব্যানারে কবি-লেখকদের রচনার উদ্ধৃতি। বাংলাদেশের কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা দেখে খুবই ভালো লাগল। বাংলাদেশ থেকে একমাত্র তাঁর উদ্ধৃতিই স্থান পেয়েছে।
কবি গুণ আমার পছন্দের মানুষ। আমি তাঁর কবিতার চেয়েও গদ্যের ভক্ত। আমার ধারণা তাঁর জন্ম হয়েছিল গদ্যকার হিসেবে। অল্প বয়সেই চুল-দাড়ি লম্বা করে ফেলায় কবি হয়েছেন। যতই দিন যাচ্ছে নির্মলেন্দু গুণের চেহারা যে রবীন্দ্রনাথের মতো হয়ে যাচ্ছে-এই ব্যাপারটা কি আপনারা লক্ষ করছেন? খুবই চিন্তার বিষয়।
আমি মেলায় ঘুরছি, আগরতলার লেখকরা গভীর আগ্রহে আমাকে তাদের লেখা বইপত্র উপহার দিচ্ছেন। নিজেকে অপরাধী লাগছে। কারণ এই যে গাদাখানিক বই নিয়ে দেশে যাব, আমি কি বইগুলি পড়ার সময় পাব? বই এমন বিষয় ভেতর থেকে আগ্রহ তৈরি না হলে পড়া যায় না। জোর করে বই পড়া অতি কষ্টকর ব্যাপার। আমি বই পড়ি আনন্দের জন্যে। যে বইয়ের প্রথম পাঁচটি পাতা আমাকে আনন্দ দিতে পারে না, সেই বই আমি পড়ি না।
আগরতলার লেখকদের যে সব বই পেলাম, তার সিংহভাগ কবিতার! বাঙলা ভাষাভাষিরা কবিতা লিখতে এবং কবিতার বই প্রকাশ করতে পছন্দ করেন। প্রতিবছর ঢাকায় জাতীয় কবিতা সম্মেলন হয়। এই উপলক্ষে কত কবিতার বই যে বের হয়। শুনেছি গত কবিতা সম্মেলনে বাংলাদেশের পাঁচ হাজার কবি রেজিষ্ট্রেশন করেছেন। কবির সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এই ব্যবস্থা। নাম রেজিস্ট্রি করে রেজিস্ট্রেশন নম্বর নিতে হয়।
কবিতা প্রসঙ্গে এইখানেই শেষ। কবিরা আমার উপর রাগ করতে পারেন। একটাই ভরসা, এই রচনা কোনো কবি পাঠ করবেন না। কবিরা গদ্য পাঠ করেন না।
.
উদয়পুর
বইমেলার সামনে বড়সড় একটা বাস দাঁড়িয়ে। এই বাসে করে আমরা যাব ত্রিপুরা থেকে সতুর কিলোমিটার দূরে উদয়পুর। বাসের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন ‘ত্রিপুরা দর্পণ’ পত্রিকার সম্পাদক সমীর বাবু। আমাদের সঙ্গে গাইড হিসেবে যাচ্ছেন কবি রাতুল দেববর্মণ। আনন্দ এবং উত্তেজনায় তিনি স্থির হয়ে এক জায়গায় বসে থাকতেও পারছেন না। ক্রমাগত সিট বদলাচ্ছেন।
বাস ছাড়বে ছাড়বে করছে-এই সময় ব্রাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর দিলীপ চক্রবর্তী উপস্থিত হলেন। মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। অতি সুদর্শন মানুষ। গায়ের রঙ সাহেবদের মতো গৌর। তিনি যখন জানলেন, বাংলাদেশ থেকে লেখকদের দল যাচ্ছে উদয়পুর-তিনি লাফ দিয়ে বাসে উঠে পড়লেন। আমাদের সফরের বাকি দিনগুলি তিনি আমাদের সঙ্গেই ছিলেন। নিজের ঘরসংসার বাদ।
আমরা আগ্রহ নিয়ে উদয়পুরের ভুবনেশ্বর মন্দির দেখতে গেলাম। এই মন্দিরে নরবলি হতো। রবীন্দ্রনাথ ‘রাজর্ষি’ লিখলেন এই মন্দির দেখে। পরে রাজর্ষিকে নিয়ে বিখ্যাত ‘বিসর্জন’ নাটকটি লেখা হলো। সবাই আগ্রহ নিয়ে ভুবনেশ্বর মন্দির দেখছে। ছবি তুলছে। আমি খটকা নিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছি। রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতির পড়ে আমি যতটুকু জানি-রাজর্ষি লেখার সময় রবীন্দ্রনাথ ত্রিপুরায় যান নি। অনেক পরে গেছেন। রাজর্ষির কাহিনী রবীন্দ্রনাথ পেয়েছিলেন স্বপ্নে। তিনি ফিরছেন দেওঘর থেকে। সারারাত ঘুম হয় নি। হঠাৎ ঝিমুনির মতো হলো। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়–
কোন্ এক মন্দিরের সিঁড়ির উপর বলির রক্তচিহ্ন দেখিয়া একটি বালিকা অত্যন্ত করুণ ব্যাকুলতার সঙ্গে তাহার বাপকে জিজ্ঞাসা করিতেছে, বাবা এ কী! এ-রক্ত! বালিকার এই কাতরতায় তাহার বাপ অন্তরে ব্যথিত হইয়া অথচ বাহিরে রাগের ভান করিয়া কোনোমতে তার প্রশ্নটাকে চাপা দিতে চেষ্টা করিতেছে।–জাগিয়া উঠিয়াই মনে হইল, এটি আমার স্বপ্নলব্ধ গল্প। এমন স্বপ্নে-পাওয়া গল্প এবং অন্য লেখা আমার আরো আছে। এই স্বপ্নটির সঙ্গে ত্রিপুরার রাজা গোবিন্দমাণিক্যের পুরাবৃত্ত মিশাইয়া রাজর্ষি গল্প মাসে মাসে লিখিতে লিখিতে বালকে বাহির করিতে লাগিলাম।
[জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ]
ভুবনেশ্বর মন্দির দর্শনের পর গেলাম ত্রিপুরেশ্বরী মন্দির দেখতে। আমি ছোটখাটো মন্দির দেখে আনন্দ পাচ্ছিলাম না। ভারতবর্ষ মন্দিরের দেশ। এমন সব মন্দির সারা ভারতে ছড়ানো যা দেখতে পাওয়া বিরাট অভিজ্ঞতা। সেই তুলনায় উদয়পুরের মন্দিরগুলি তেমন কিছু না।