আমাদেরকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন ব্যান্ড তারকা জেমস। নিজেই খাবার এনে দিলেন। আর কিছু লাগবে কি-না অতি বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন। আমি তার ভদ্রতায় মুগ্ধ হয়ে গেলাম। তাকে বললাম, আপনার মা নিয়ে গাওয়া গানটি শুনেছি। মা নিয়ে সুন্দর গান করলেন, শাশুড়িকে নিয়ে গান নেই কেন? প্রায় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, শাশুড়িরা জামাইকে মায়ের চেয়েও বেশি আদর করে।
আমার কথা শুনে আঁকড়া চুলের জেমস কিছুক্ষণ আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে হঠাৎই হোটেল কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করলেন। এমন প্রাণময় হাসি আমি অনেক দিন শুনি নি।
পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানটি জমকালো। লোকে লোকারণ্য। সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। আয়োজকদের মধ্যে প্রবল উত্তেজনা। উত্তেজনার মূল কারণ, একজন ভারতীয় শিল্পী রাণী মুখাজি (ছায়াছবি ব্ল্যাক খ্যাত) দয়া করে পুরস্কার নিতে রাজি হয়েছেন। তিনি না কি যে কোনো মুহূর্তে চলে আসতে পারেন। শুধু পুরস্কার হাতে তুলে নেবেন–এই কারণে তাকে বিপুল অঙ্কের ডলার দিতে হচ্ছে। এই নিয়েও আয়োজকদের দুশ্চিন্তা নেই। কারণ স্পন্সরদের মধ্যে ঠেলাঠেলি পড়ে গেছে এই বিশেষ পুরস্কারটি স্পন্সর করা নিয়ে। ডলার কোনো সমস্যা না, রাণী মুখার্জির হাতে পুরস্কার তুলে দেয়ার দুর্লভ সম্মান পাওয়াটাই সমস্যা।
রাণী মুখাজি এসে উপস্থিত হলেন। সঙ্গে বডিগার্ড। বাংলাদেশের অনেক শিল্পী এবং শিল্পীর মায়েরা আধপাগল হয়ে গেলেন। তাদের আহ্লাদী দেখে আমি দূর থেকে লজ্জায় মরে গেলাম। একবার মনে হলো, জাতিগতভাবেই কি আমরা হীনমন্য? কবে আমরা নিজেদের উপর বিশ্বাস ফিরে পাব? রাণী মুখার্জিকে নিয়ে আহ্লাদীর একটা উদাহরণ দেই। আমাদের দেশের একজন অভিনেত্রী ছুটে গেলেন। গদগদ ভঙ্গিতে ইংরেজি এবং হিন্দি মিশিয়ে বললেন, আমি বিশ্বাস করছি আমি আপনাকে চোখের সামনে দেখছি। আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি আপনাকে একটু জড়িয়ে ধরতে চাই।
রাণী মুখার্জি : Please no. You can take picture.
বাংলাদেশী অভিনেত্রী : আমি কোনো কথা শুনব না। আমি আপনাকে ছুঁয়ে দেখবই।
রাণী মুখার্জি : Don’t touch me. Take picture,
বাংলাদেশী অভিনেত্রী : আপনার সঙ্গে হ্যান্ডশেক না করলে আমি মরেই যাব।
রাণী মুখার্জি নিতান্ত অনিচ্ছায় এবং বিরক্তিতে হাত বাড়ালেন। বাংলাদেশের নামি অভিনেত্রী সেই হাত কচলাতে লাগলেন।
আমি প্রতিজ্ঞা করলাম জীবনে কখনো বিদেশে কোনো পুরষ্কার নিতে যাব না। এই জাতীয় দৃশ্য দ্বিতীয়বার দেখার কোনো সাধ আমার নেই।
বাংলাদেশের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যে যেমন হীনমন্যতার ব্যাপার আছে, লেখকদের মধ্যেও আছে। তার একটি গল্প করি।
বাংলাদেশে জনৈক লেখক (নাম বলতে চাচ্ছি না) গিয়েছেন কোলকাতায়। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে দেখা করবেন। বাড়ি খুঁজে বের করে অনেকক্ষণ কলিংবেল টেপাটেপি করলেন। তাকে অবাক করে দিয়ে সত্যজিৎ রায় নিজেই দরজা খুললেন। তবে পুরোপুরি খুললেন না। প্রবেশপথ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। লেখক বৈঠকখানায় ঢুকতে পারছেন না। লেখক বললেন, আমার নাম …. আমি বাংলাদেশের একজন লেখক। নানান বিষয়ে বিশেষ করে শিশুসাহিত্যে আমার প্রচুর বই প্রকাশিত এবং সমাদৃত হয়েছে।
সত্যজিৎ : ও আচ্ছা।
লেখক : আমি আপনার ঠাকুরদা উপেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর উপর বিশাল একটি বই লিখেছি।
সত্যজিৎ : ও আচ্ছা।
লেখক : আমি আপনার বাবা সুকুমার রায়ের জীবন ও কর্ম নিয়ে একটা বই লিখেছি।
সত্যজিৎ: হুঁ।
লেখক : আমি আপনার উপরও একটি বই লিখেছি।
সত্যজিৎ : ধন্যবাদ।
লেখক : আপনার উপর লেখা বইটি আমি নিজের হাতে আপনাকে দিতে এসেছি।
সত্যজিৎ : আমার বাড়িটা ছোট। এত বই রাখার জায়গা আমার নেই। কিছু মনে করবেন না।
সত্যজিৎ রায় ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি এই গল্পটি অনেকের কাছে শুনেছি। সর্বশেষ শুনেছি ‘প্রথম আলো’ পত্রিকার সাজ্জাদ শরীফের কাছে। যারা বাংলাদেশের ঐ লেখকের নাম জানতে আগ্রহী, তারা সাজ্জাদ শরীফের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।
স্থান : হোটেল রেডিসনের ঘর।
সময় : সকাল দশটা।
হোটেলের রুম সার্ভিসকে টেলিফোন করেছি নাশতা দিয়ে যাবার জন্যে। নিজের টাকা খরচ করে খাব, আয়োজকদের উপর ভরসা করব না। রুম সার্ভিস থেকে আমাকে জানানো হলো, বাংলাদেশের গেস্টদের যে সব ঘর দেয়া হয়েছে সেখানে রুম সার্ভিস নেই।
ভালো যন্ত্রণায় পড়লাম। নাশতার কুপনও নেই। জেমসকেও আশেপাশে দেখা যাচ্ছে না যে তার কাছে সাহায্য চাইব। এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। কেউ যেন অতি সাবধানে দু’বার বেল টিপেই চুপ করে গেল। আর সাড়াশব্দ নেই। আমি দরজা খুলে হতভম্ব। হাসি হাসি মুখে তিন মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। একজন ‘অন্যদিন’ পত্রিকার সম্পাদক মাজহার। সে এসেছে বাংলাদেশ থেকে। আরেকজন অভিনেতা স্বাধীন, সে এসেছে লন্ডন থেকে। তৃতীয়জন এসেছে কানাডা থেকে, ‘অন্যদিন’-এর প্রধান সম্পাদক মাসুম। বর্তমানে কানাডা প্রবাসী। তারা তিনজন যুক্তি করে আমাকে কোনো কিছু না জানিয়ে একই সময় উপস্থিত হয়েছে শুধুমাত্র আমাকে এবং শাওনকে সারপ্রাইজ দেবার জন্যে।
আমরা সারপ্রাইড হলাম, আনন্দিত হলাম, উল্লসিত হলাম। আমার জীবনে আনন্দময় সঞ্চয়ের মধ্যে এটি একটি। তারা অতি দ্রুত রেন্ট-এ-কার থেকে বিশাল এক গাড়ি ভাড়া করে ফেলল। যতদিন আমেরিকায় থাকব ততদিন এই গাড়ি আমাদের সঙ্গে থাকবে। আমরা যেখানেই ইচ্ছা সেখানে যাব।