সুইস: তোমরা কী করছ জানতে পারি?
শাহীন : পিকনিক করছি। ফ্যামিলি হলি ডে।
সুইস : তোমরা কি জানো যে, এটা একটা পাবলিক প্রপার্টি? আপেল এবং নাসপাতি বাগান আমার।
শাহীন; আমরা তো আপেল এবং নাসপাতি বাগানে যাচ্ছি না। আমরা নদীর ধারে পিকনিক করছি।
সুইস : এই জায়গাও আমার। [কুৎসিত গালি। গালির অর্থ কী শাহীন বলল না। এতে মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু হবে।]
শাহীন : [গালি, সে জার্মান গালির সঙ্গে বাঙলা গালি মিশিয়ে দিল। বাংলা ভাষায় সবচে’ ভদ্র গালিটা ছিল-খা–কির পুলা অফ যা।]
সুইস : আমি তোমাদের পুলিশে ধরিয়ে দেব।
শাহীন : যা তোর বাপদের খবর দিয়ে আয়।
সুইস দু’জন হুস করে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেল। আমি সব শুনে বললাম, অন্যের জায়গায় আমরা কেন পিকনিক করব? চল আরেকটা জায়গা খুঁজে বের করি।
শাহীন বলল, স্যার সুইস সরকারের আইন বলে নদীর পাড় ঘেঁসে সমস্ত সুন্দর জায়গায় সবার অধিকার। এটা যদি ওর জায়গাও হয় তারপরেও আমাদের অধিকার আছে এখানে পিকনিক করার।
আমি বললাম, ব্যাটা তো মনেহয় পুলিশে খবর দিতে গেল।
শাহীন বলল, পুলিশে খবর দেবে না, কারণ আইন আমাদের পক্ষে। পুলিশে খবর দিলে নিজেই বিপদে পড়বে, তবে সে বন্দুক নিয়ে ফিরে আসতে পারে।
বলো কী?
বন্দুক দিয়ে গুলি করবে না-ফাঁকা আওয়াজ করে ভয় দেখাবে।
আমরা তখন কী করব?
ফাইট দিব। মেরে তক্তা বানিয়ে ফেলব। এখনো বাঙালি চেনে না।
শাহীন আবারো খানকি বিষয়ক গালিতে ফিরে গেল।
আমি স্তম্ভিত। এ কী বিপদে পড়লাম! আমি একা স্থান ত্যাগের পক্ষে, বাকি সবাই ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সুচাগ্র মেদেনী’ টাইপ মেয়েরা বিশেষ করেই রণরঙ্গিনী। বাঙালি রমণী কী বিষয় তারা তা সুইসদের শিখিয়ে দিতে আগ্রহী।
চ্যালেঞ্জার লুঙ্গি পরে রাইন নদীর সুশীতল জলে সাঁতার কাটছিল। সে উঠে এসে লুঙ্গি বদলে প্যান্ট পরল। লুঙ্গি পরে মারামারি করা যায় না।
আমার সিক্সথ সেন্স বলছিল ওরা ফিরে আসবে না ঝামেলা কে পছন্দ করে।
আমার সিক্সথ সেন্স ভুল প্রমাণিত করে সেই দু’জন গাড়ি করে আবার উপস্থিত হলো। শাহীন বারবিকিউর চুলা থেকে জ্বলন্ত চ্যালাকাঠ তুলে হাতে নিল। স্বাধীনের দিকে তাকিয়ে দেখি তার হাতে সুইস নাইফ।
দু’জন গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে এল। তাদের হাতে বন্দুক দেখা গেল না। তবে পিস্তল জাতীয় কিছু পকেটে থাকতে পারে।
শাহীনের সঙ্গে তাদের নিম্নলিখিত কথাবার্তা হলো।
সুইস : আমরা সরি বলার জন্যে এসেছি। তোমাকে যে সব গালাগালি করেছি তার জন্যে Sory, আমাদের এ উপলব্ধি গ্রহণ করলে খুশি হব।
শাহীন : এ উপলব্ধি গ্রহণ করা হলো।
সুইস : তোমরা কোন দেশ থেকে এসেছ?
শাহীন : আমার বন্ধুরা বাংলাদেশ থেকে এসেছেন, আমি সুইস নাগরিক।
সুইস : তোমাদের পিকনিক শুভ হোক।
শাহীন: অল্পের জন্যে বাঁচলি, আইজ তরে জানে মাইরা ফেলতাম।
সুইস : কী বললে বুঝতে পারলাম না।
শাহীন : বাংলা ভাষায় বলেছি, তোমাদের ধন্যবাদ।
মহান বাঙালির সম্মান বজায় রইল। শুটিংয়ের শেষে খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে। আমি ঘোষণা দিলাম, আগামীকাল অফ ডে। আমরা কোনো শুটিং করব না।
হাসানের মুখ শুকিয়ে গেল। শুটিং অফ মানে আরেকদিন বাড়তি থাকা। বাড়তি খরচ। বাড়তি টেনশন।
আমি হাসনকে আশ্বস্ত করার জন্যে বললাম, তুমি টেনশন করো না। আমরা Extra কাজ করে আগামীকালের ক্ষতি পুষিয়ে দেব।
আগামীকাল কাজ করবেন না কেন?
আগামীকাল অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা। আমি ক্রিকেট খেলা দেখব।
শাহীন বলল, ক্রিকেট খেলা দেখা যাবে না।
কেন দেখা যাবে না?
শাহীন বলল, এখানকার কোনো বাঙালির বাড়িতে ডিশের লাইন নেই। খরচের ভয়ে তারা ডিশ লাইন নেয় না।
আমি বললাম, রেস্টুরেন্টগুলোতে খেলা দেখার ব্যবস্থা নেই?
সুইসরা ক্রিকেট ভক্ত না। তারা ফুটবল ছাড়া কোনো খেলা দেখে না।
আমি হাসানের দিকে ফিরে বললাম, তোমার দায়িত্ব কাল আমাকে খেলা দেখানো।
হাসান বলল, অবশ্যই।
পাঠকরা ভুলেও ভাববেন না-আমি ক্রিকেটের পোকা, কে কখন কয়টা ছক্কা মেরেছে, কে কতবার শূন্যতে আউট হয়েছে, এসব আমার মুখস্থ। মোটেও না। আমি শুধু বাংলাদেশের খেলা থাকলেই দেখি। অন্য খেলা না।
বাংলাদেশের কোনো খেলা আমি মিস করি না। ঐ দিন আমার সকল কর্মকাণ্ড বন্ধ। বাংলাদেশের কোনো খেলোয়াড় যখন চার মারে, আমার কাছে মনে হয় চারটা সে মারে নি। আমি নিজে মেরেছি। এবং আমাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে। বাংলাদেশের কোনো বোলার যখন কঠিন বল করে তখন আমার মনের ভাব হচ্ছে-’বলটা কেমন করলাম দেখলিরে ছাগলা? কলজে নড়ে গেছে কি-না বল। আসল বোলিং তো শুরুই করিনি। তোকে আজ পাতলা পায়খানা যদি না করাই আমার নাম হুমায়ূন আহমেদই না।
আনন্দে চোখে পানি আসার মতো ঘটনা আমার জীবনে অনেকবার ঘটেছে। যে ক’বার বাংলাদেশ ক্রিকেট জিতেছে প্রতিবারই আমার চোখে পানি এসেছে। বাংলাদেশী ক্রিকেটের দুর্দান্ত সব খেলোয়াড়দের ধন্যবাদ। তারা চোখভর্তি পানি নিয়ে আসার মতো আনন্দ একজন লেখককে বারবার দিচ্ছেন। পরম করুণমায় এইসব সাহসী তরুণের জীবন মঙ্গলময় করুক, এই আমার শুভকামনা।
আমরা যেখানে আমি (রুখতেনস্টাইন) সেখানে ক্রিকেট খেলা দেখার কোনো ব্যবস্থা হাসান করতে পারল না। তাকে পরাজিত ও বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল। সে বাসে করে আমাদের নিয়ে রওনা হলো সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জুরিখে। জুরিখে অনেক বাঙালি, তাদের কারো বাসায় Star Sports কিংবা ESPN তো থাকবেই।