ভিডিওর কাজে আমাকে পুরোপুরি নির্ভর করতে হলো ক্যামেরাম্যান এবং শাওনের উপর।
ক্যামেরাম্যানের নাম তুফান। ঝকঝকে চোখের লম্বা পোশাকে ফিটফাট যুবা পুরুষ। মাথাভর্তি টাক না থাকলে তাকে নায়কের চরিত্র দেয়া যেত। তুফান ভারী ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে তুফানের মতোই ছোটাছুটি করে। ক্যামেরা কাঁধেই রাখতে হবে, ষ্ট্যান্ডে বসানোর উপায় নেই। পুলিশ চলে আসতে পারে। হোম ভিডিও যারা করে তারা ক্যামেরার জন্যে ষ্ট্যান্ড নিয়ে আসে না।
আমি চিন্তিত, ক্যামেরায় কী ছবি আসছে কে জানে! আমাদের সঙ্গে না আছে লাইট, না আছে লাইট কাটার, না আছে শব্দ ধারণের ধুম। শব্দের সমস্যার সমাধান আছে, পরে ডাব করা যাবে। ছবি নষ্ট হলে কী করব! কাঁধের ক্যামেরা যদি কাঁপে ছবিও কাপবে। এত দূর দেশে এসে যদি এমন ছবি নিয়ে যাই যা দেশে মনে হবে পাত্র-পাত্রী সবাই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত, সবার মধ্যেই কাঁপুনি, তাহলে হবে কী?
তুফান আমাকে আশ্বস্ত করল। সে বলল, স্যার সব ঠিক আছে, আপনি মোটেও চিন্তা করবেন না। উপরে আল্লাহ আছেন।
উপরে নিচে সবদিকেই আল্লাহ আছেন, তবে তিনি চুরি করে ভিডিও গ্রহণের ব্যাপারটার কি ভালোমতো নেবেন?
এদিকে প্রথম দিনেই দু’টি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল। স্বাধীন এক অতি রূপবতীর (হুমায়ূন আহমেদের নায়িকাদের চেয়েও রূপবতী) প্রেমে পড়ে গেল। মেয়ে সুইস, জার্মান ছাড়া অন্য ভাষা জানে না। স্বাধীন ও ইংরেজি এবং সিলেটি ভাষা ছাড়া কিছু জানে না। প্রেম একপক্ষীয় না, দুপক্ষীয় আমি কিছুতেই বুঝতে পারলাম না, ইশারার ইঙ্গিতে কী করে এত অল্প সময়ে এমন গভীর প্রেম হয়!
সন্ধ্যাবেলায় দেখি স্বাধীন উসখুস করছে। জানা গেল মেয়ে তাকে ডিনারের নিমন্ত্রণ করেছে। রাতে যদি কাজ না করি তাহলে সে ডিনারে যাবে। আমি ডিনারে যাবার অনুমতি দিলাম।
স্বাধীন আবেগমথিত গলায় বলল, আমাদের জন্যে একটু দোয়া করবেন হুমায়ূন ভাই।
আমি বললাম, দোয়া লাগবে কেন?
সে বলল, আমরা বিয়ের কথা চিন্তা করছি। সে শুধু একটা শর্ত দিয়েছে।
কী শর্ত?
পরে আপনাকে বলব।
স্বাধীন ডেটিং-এ চলে গেল তার চেহারা চোখ-মুখ উদভ্রান্ত।
দ্বিতীয় সমস্যা এজাজ এবং ফারুককে নিয়ে। তারা ডলার যা এনেছে প্রথম দিনেই সব শেষ। দু’জন এখন কপর্দকশূন্য। দুজনই মুখ শুকনা করে বসে আছে।
আমি বললাম, কেনাকাটা কী করেছ যে প্রথম দিনেই সব শেষ?
সাবান কিনেছি।
সাবান কিনেছ মানে কী?
দু’জনই স্যুটকেস বের করল। সুটকেস ভর্তি শুধু সাবান। নানান রঙের, নানান ঢং-এর।
এত সাবান কেন কিনেছ?
ফারুক বলল, দেখে এত সুন্দর লাগল। তাছাড়া দেশে এই জিনিস পাওয়া যায় না।
হাসান দুজনকেই তিনশ’ ডলার করে দিল। এরা পরের দিন সেই ডলার দিয়েও সাবান কিনে ফেলল।
ডাক্তার এজাজ সাবানের বস্তা নিয়ে দেশে ফিরতে পারে নি। এয়ার লাইন তার সাবানভর্তি দু’টা স্যুটকেসেই হারিয়ে ফেলে। ফারুক সাবান নিয়ে দেশে ফিরতে পেরেছে। শুনেছি এইসব সাবানের একটাও সে নিজে ব্যবহার করে নি, কাউকে ব্যবহার করতেও দেয়নি। সবই সাজিয়ে রাখা। তার জীবনের বর্তমান স্বপ্ন আবার বিদেশে গিয়ে সাবান কিনে নিয়ে আসা।
শুটিং পুরোদমে চলছে। সুইজারল্যান্ডের সুন্দর সুন্দর জায়গা ব্যবহার করা হচ্ছে। রাইন নদী, রাইনস ফল, নেপোলিয়ানের বাড়ি-কিছুই বাদ যাচ্ছে না।
খুব উৎসাহ নিয়ে রাইন নদী দেখে ধাক্কার মতো খেলাম। আমরা পদ্মা মেঘনার দেশের মানুষ, আমাদেরকে কি বড় সাইজের খাল দিয়ে ভুলানো যায়? তার সবই ঝকঝকে। মনে হয় পুরো সুইজারল্যান্ডকে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে রাখা হয় শুধুমাত্র ছবি ভোলার জন্যে। গাছের প্রতিটি পাতা সবুজ। একটা শুকনা পাতা বা মরা ডাল নেই। গাছের নিচেও শুকনা পাতা পড়ে থাকা দরকার। সেইসব কোথায় গেল? পাতা কুড়ানির দল তো চোখে পড়ল না।
নাটকে পিকনিকের একটি দৃশ্য আছে। বেশ বড় দৃশ্য। এই দৃশ্যে পুরো একটা গান আছে। নাটকীয় অনেক ব্যাপার-স্যাপার আছে। পিকনিকের দৃশ্য করার জন্যে রাইন নদীর পাশে ছোট্ট পার্কের মতো একটা জায়গী শাহীন এবং হাসান খুঁজে বের করল।
ছবির দেশে সবকিছুই ছবির মতো। পার্কটাও সে-রকম। নাগরিক সুযোগ সুবিধা আছে অর্থাৎ বাথরুম আছে। বারবিকিউয়ের ব্যবস্থা আছে। একপাশেই আপেলের বাগান। গাছভর্তি আপেল। অন্যপাশে নাসপাতি বাগান। ফল ভারে প্রতিটি বৃক্ষ নত। আমরা মহানন্দে বারবিকিউয়ের ব্যবস্থায় লেগে গেলাম। মেয়েরা মনের আনন্দে ছুটাছুটি করতে লাগল। তাদের মুগ্ধ করল রাইন নদীতে সাতার কাটতে ব্যস্ত একদল রাজহাঁস। সাইজে দেশী রাজহাঁসের প্রায় দ্বিগুণ! গলা অনেক লম্বা। শুনেছি এরা প্রকৃতিতে ভয়ঙ্কর। মেজাজ খারাপ হলে এরা বিকট শব্দ করে ছুটে এসে কামড়ে দেয়।
মেয়েরা রাজহাঁসের পোষ মানিয়ে ফেলল। তারা হাতে পাউরুটি ধরে এগিয়ে দিচ্ছে। রাজহাঁসের দল কাড়াকাড়ি করে খাচ্ছে। মেয়েদের জঙ্গি রাজহাঁসদের দলকে পোষ মানানোর ক্ষমতায় অবাক হলাম না। যারা পুরুষদের পোষ মানায়, তারা সবাইকে পোষ মানাতে সক্ষম।
আমাদের আনন্দ-উল্লাসে হঠাৎ বাধা পড়ল। দুই সুইস জিপ গাড়িতে করে উপস্থিত। শাহীনের সঙ্গে তাদের নিম্নলিখিত কথাবার্তা হলো। আমরা তার এক বর্ণও বুঝলাম না। সব কথাই হলো জার্মান ভাষায়। এখানে বাঙ্গানুবাদটা দিচ্ছি।