আল্লাহপাকের অসীম রহমত, সে সমস্যাটা বুঝল। এমন এক ভাব করল যেন সবাই মিলে মেঝেতে গড়াগড়ি করার সুযোগ পেয়ে তার জীবন ধন্য। অভিনয় খুব ভালো হলো না। সে হতাশী লুকাতে পারল না।
রাতে ডিনার খেলাম হাসানের বিশেষ নৈপুণ্যে রাঁধা ডাল দিয়ে। ফার্মের মুরগি ছিল। ফার্মের মুরগি আমি খাই না। ঘন কৃষ্ণবর্ণের একটা বস্তুও ছিল। প্রশ্ন করে জানা গেল এটা সবজি। রান্নার গুণে কালো হয়ে গেছে।
ডাক্তার এবং ফারুক সবজি খেয়ে বলল, অসাধারণ। সুইজারল্যান্ডে পৌঁছার পর থেকে তারা যা দেখছে বলছে অসাধারণ। খাবার টেবিলে কাঁচামরিচ দেখে বলল, অসাধারণ। সুইজারল্যান্ডেও কাঁচামরিচ আছে, আশ্চর্য! কাঁচামরিচে কামড় দিয়ে দেখে মিষ্টি। তখনো বলল, অসাধারণ। ঝাল নেই কাঁচামরিচ খেয়েছি। মিষ্টি কাঁচামরিচ এই প্রথম খাচ্ছি। মুহূর্তের মধ্যে এই দুজন টেবিলের সব কাঁচামরিচ শেষ করে ফেলল।
রাতে আমার এবং শাওনের থাকার ব্যবস্থা হলো জেলখানার সেলের চেয়েও ছোট একটা ঘরে। বিছানায় দু’জনের শোবার প্রশ্ন উঠে না। আমি মেঝেতে চাদর পেতে ঘুমুতে গেলাম। ফ্যানের সমস্যা আছে। ফ্যানটা জীবন্ত প্রাণীর মতো আচরণ শুরু করল। ঘুরতে ঘুরতে সে থেমে যায়। কাশির মতো শব্দ করে। আবার ঘুরে আবার থামে। পুরোপুরি এক স্বাধীন সত্তা।
টুটুল-তানিয়া দম্পত্তিকে একটা রুম দেয়া হয়েছে। সাইজে আমাদেরটার চেয়ে ছোট। তার উপর নেই ফ্যান।
বাকি সবার গণবিছানা। সেই ঘরে ও ফ্যান নেই। সবাই গরমে অতিষ্ঠ। বাড়ির মালিক আমাদের জানালেন, সুইজারল্যান্ড অতি ঠাণ্ডার দেশ বলে ফ্যানের প্রচলন নেই। এসির তো প্রশ্নই উঠে না। সামারের এক দুই মাস গরম পড়ে। এই গরম সবাই Enjoy করে। গরমটাই তাদের কাছে মজা লাগে। আমাদের কারোই মজা লাগল না। শুধু ডাক্তার এজাজ এবং ফারুক বলল, অতি আরামদায়ক আবহাওয়া।
ঘুমুতে যাবার আগে আগে আমি আমার দলের সবাইকে ডেকে একটা গোপন মিটিং করলাম। আমি বললাম, বুঝতে পারছি এখানে থাকা-খাওয়ার ব্যাপারটা কারো পছন্দ হচ্ছে না। আমাদের বাস্তবতা মানতে হবে। একটা টিভি চ্যানেল এতগুলো মানুষকে এত দূরের দেশে নিয়ে এসেছে। ইউরোপে হোটেল ভাড়া আকাশছোঁয়া। তাদের পক্ষে কোনো রকমেই সম্ভব না সবাইকে হোটেলে রাখা। তোমরা দয়া করে নায়ক-নায়িকাদের মতো নখরা করবে না। তোমরা চরিত্র অভিনেতা। চরিত্র অভিনেতারা অভিনয় করে, নখরা করে না।
তারচেয়ে বড় কথা হাসান আমার ছাত্র তাকে আমি পছন্দ করি। সে যেন তোমাদের কোনো কথায় বা আচরণে কষ্ট না পায়। তার আগ্রহের কারণেই তোমরা ভূস্বর্গ হিসেবে পরিচিত একটা দেশ দেখবে। এর মূল্যও কম না। সারাদিন আমরা কাজ করব। রাতে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ব। এক ঘুমে রাত কাবার। সামান্য কয়েক ঘণ্টার জন্যে কি ফাইভ স্টার হোটেল লাগবে?
কথা দিয়ে মানুষকে ভোলানোর ক্ষমতা আমার আছে! (কথাশিল্পী না?) সবাই বুঝল। ফারুক অতি আগ্রহের সঙ্গে বলল, প্রয়োজনে মেঝেতে শুয়ে থাকব। আমি বললাম, মেঝেতেই তো শুয়ে আছ। সে চুপ করে গেল।
ভোরবেলা দলবল নিয়ে শুটিং করতে বেরুবার সময় সবচে বড় দুঃসংবাদটা শুনলাম। আমাদের শুটিং করতে হবে চুরি করে। পুলিশ দেখতে পেলেই ধরে নিয়ে যাবে। কারণ শুটিং-এর অনুমতি নিতে বিপুল অংকের অর্থ লাগে। ইনস্যুরেন্স করতে হয়।
হাসান সহজ ভঙ্গিতে বলল, পুলিশ আছে কি নেই এটা দেখে শুটিং করতে হবে। পুলিশ যদি ধরে ফেলে তাহলে বলতে হবে আমরা বেড়াতে এসেছি। হোম ভিডিও করছি। দেশে বন্ধুবান্ধবকে দেখাব।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। শুটিংটা হবে কীভাবে?
হাসান বলল, নিশ্চিন্ত থাকেন। ফাঁক ফোকর দিয়ে বের করে নিয়ে আসব। শুধু শুটিং চলাকালীন সময় আপনি ধারে কাছেও থাকবেন না। এটা সাগর ভাইয়ের অর্ডার।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, আমি ধারে কাছে থাকব না কেন?
হাসান বলল, পুলিশ যদি আপনাকে ধরে নিয়ে যায় তাহলে বিরাট কেলেঙ্কারি হবে। বাংলাদেশ এম্বেসি ধরে টান পড়বে।
আমার কলিজা গেল শুকিয়ে।
প্রথম দৃশ্য শুরু হলো। বাংলাদেশের এক ছেলে অন্ধ সেজে গিটার বাজিয়ে ভিক্ষা করে। তার স্ত্রী এসে (শাওন) তাকে এখান থেকে বকাঝকা করতে করতে নিয়ে যায়। অন্ধ ছেলের ভূমিকায় অভিনয় করছে টুটুল। তাকে ফোয়ারার পাশে দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো। সামনে হাতে লেখা সাইনবোর্ড–Help a blind.
টুটুলের গলা চমৎকার। গিটারের হাত চমৎকার। সে মুহূর্তের মধ্যেই জমিয়ে ফেলল। ক্যামেরা অনেক দূরে। কেউ বুঝতেই পারছে না ক্যামেরা চলছে। এক থুরথুরি বুড়ি চোখ বড় বড় করে কিছুক্ষণ গিটার শুনে দশ ইউরো একটা নোট টুটুলের হাতে গুঁজে দিল। টুটুল বিস্মিত।
এখন শাওন যাবে, টুটুলকে বকাঝকা করতে করতে নিয়ে আসবে-ঠিক তখন স্বাধীন হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, হুমায়ূন ভাই, পুলিশ আসছে।
আমি কাউকেই চিনি না এমন ভঙ্গিতে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটা দিলাম। শাওন বলল, তুমি আমাকে ফেলে চলে যাচ্ছ কেন?
কিছুক্ষণের মধ্যেই চুরি করে নাটক বানানোর মজা পেয়ে গেলাম। নিষিদ্ধ কিছু করছি, এই আনন্দ প্রধান হয়ে গেল। ফ্রেম কী হচ্ছে জানি না। মনিটর নেই। অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর নেই। লেফট ইন রাইট আউট নামক জটিল বিষয় আমার মোটা মাথায় কখনো ঢোকে না। আমার সাহায্যে শাওন এগিয়ে এল। সে আবার আগমন নির্গমন এবং ‘লুক’ খুব ভালো বোঝে। ‘লুক’ বিষয়টা কী পাঠকদের বুঝিয়ে দেই। ‘লুক’ হলো পাত্রপাত্রী কোন দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কথা বলছে। ভিডিওতে এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লুক ঠিক না হলে দেখা যাবে নায়ক তার বান্ধবীর দিকে না তাকিয়ে সম্পূর্ণ উল্টো দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে মাথা নাড়ছে এবং কথা বলছে।