তাছাড়া টিভি নাটকে প্রকৃতি দেখানোর তেমন সুযোগ কোথায়? টিভি নাটকে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক দেখানো হয়। প্রকৃতি সেখানে গৌণ। টিভি পর্দায় Depth of field আসে না বলে প্রকৃতির অতি মনোরম দৃশ্যও মনে হয় two dimensional. সাদা কথায় ফ্ল্যাট।
তাহলে আমি সুইজারল্যান্ড কেন যাচ্ছি? আমার এক প্রাক্তন ছাত্রের কথার জাদুতে বিভ্রান্ত হয়ে। ছাত্রের নাম হাসান। সে চ্যানেল আই-এর কর্তাব্যক্তিদের একজন। এইচআরভি নামক দামি এক জিপে করে গম্ভীর ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়ায়।
আমি যখন শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর সে ঐ হলের ছাত্র। হৃদয়ঘটিত কোনো এক সমস্যায় জর্জরিত। অর্থনৈতিকভাবেও পর্যদস্ত। এমন সময়ে সে আসে আমার সঙ্গে দেখা করতে। তার আবদার-এমন কিছু যেন বলি যাতে তার মন শান্ত হয়। আমি তাকে কী বলেছিলাম তা এখন আর তার মনে নেই। তবে হাসানের মন শান্ত হয়েছিল-এই খবর সে আমাকে দিয়েছে।
সেই হাসান সুইজারল্যান্ডের কথা বলে আমাকে প্রায় কাবু করে ফেলল।
স্যার, ভূস্বর্গ! আপনি ভূস্বর্গ দেখবেন না? রথ দেখবেন এবং কলা বেচবেন। নাটক ও হলো, ভূস্বর্গও দেখা হলো।
বিদেশে নাটক করার নতুন হুজুগ ইদানীং শুরু হয়েছে। একজন নায়ক এবং একজন নায়িকা যান। তারা সুন্দর সুন্দর জায়গায় যান। প্রেম করেন। গান করেন। স্থানীয় কিছু ছেলেমেয়ে আনা হয়। তারা যেহেতু কখনো ক্যামেরার সামনে আসে নি তারা রোবটের মতো আসে। চোখ-কান বন্ধ করে দু’একটা সংলাপ কোনোমতে বলে।
এ ধরনের নাটক করা তো আমার পক্ষে সম্ভব না। নায়ক-নায়িকা নির্ভর নাটক আমি লিখতেও পারি না। হাসানকে এই কথা বলতেই সে বলল, আপনার যে ক’জনকে নিতে হয় নেবেন। কোনো সমস্যা নেই। দশজন নিলে দশজন। পনেরোজন নিলে পনেরোজিন।
আমি আশ্চর্যই হলাম। হাসান বলল, বিশাল দুটা বাড়ি আমি আপনাদের জন্যে এক মাসের জন্যে ভাড়া করেছি। বাড়িতে থাকবেন। নিজের মতো রান্না করে খাবেন। একজন বাবুর্চিকেও অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছে।
হাসানের কর্মকাণ্ডে আমি মুগ্ধ। তারপরেও মন টানছে না। কেন জানি বাইরে যেতে ইচ্ছে করে না। নিজের দেশের ঘরের এক কোণে সারাদিন বসে থাকতে ভালো লাগে। হাসানকে না করে দিলাম। ইতিমধ্যে সুইজারল্যান্ডে নাটক বানানোর প্রস্তাব প্রকাশ হয়ে গেছে। আমার সঙ্গে যারা কাজ করে তাদের খুব আগ্রহ যেন আমি রাজি হই।
রাজি হলাম। হাসানের হাতে শিল্পীদের একটা তালিকা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, এদের সবাইকে যদি নিয়ে যেতে পারি তাহলে OK.
হাসান বলল, আরো আরো নিতে পারেন। আমি তো বলেছি কতজনকে নেবেন আপনার ব্যাপার।
আমি আবারো চমৎকৃত হলাম। তালিকাটা যথেষ্টই বড়।
রিয়াজ, শাওন, চ্যালেঞ্জার, স্বাধীন খসরু, ডাক্তার এজাজ, ফারুক আহমেদ, টুটুল, তানিয়া।
আমাকে নিয়ে নয়জন। হাসান নিমিষের মধ্যে ভিসা করিয়ে ফেলল। যথাসময়ে বিমানে উঠলাম। ডাক্তার এজাজ এবং ফারুক আহমেদের এই প্রথম দেশের বাইরে যাত্রী। তাদের আনন্দ এবং উত্তেজনা দেখে ভালো লাগল। রিয়াজ অবশ্যি যেতে পারল না। শেষমুহর্তে তার জরুরি কাজ পড়ে গেল। ব্যস্ত নায়করা শেষমুহূর্তে জরুরি কাজ বের করে মূল পরিকল্পনা বানচাল করে ফেলেন। আমি এই ‘শেষমুহূর্ত’ নিয়ে প্রস্তুত ছিলাম বলে তেমন সমস্যা হলো না।
আমি লক্ষ করেছি, ঢাকা শহরে খুব দামি গাড়ি চড়ে যারা ঘোরে তারা খোলামেলা কথা বলতে পারে না। দরজা-জানালা বন্ধ এসি গাড়িতে থাকার কারণেই মনে হয় এটা হয়।
হাসানের কাছে শুনেছিলাম একটা বিশাল বাড়ি ভাড়া করা হয়েছে, বাস্তবে দেখা গেল শাহীন নামে সুইজারল্যান্ড প্রবাসী এক ছেলে তার ফ্ল্যাটের দু’টা কামরা ছেড়ে দিয়েছে। একজন বাবুর্চি অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেয়া হয়েছিল বলে শুনেছিলাম, দেখা গেল বাবুর্চি আমাদের হাসান। সে উৎসাহের সঙ্গে জানালো যে, ডাল রান্নায় তার নৈপুণ্য অসাধারণ। তিনদিনের ভাল বেঁধে সে না–কি ডিপ ফ্রিজে রেখেও দিয়েছে।
ব্যবস্থা দেখে আমার প্রায় স্ট্রোক হবার জোগাড় হলো। আমি খুবই গরিবের ছেলে। গরিবের ছেলের হাতে যদি দুটা পয়সা হয়, তখন তার মধ্যে নানা বিলাসিতা ঢুকে পড়ে। আমার মধ্যেও ঢুকেছে। শীতের দিনেও আমি এসি ছেড়ে ভাবল লেপ গায়ে দেই।
সুইজারল্যান্ডে যথেষ্ট গরম। ঘরে এসি নেই। সিলিং পাখাও নেই। কয়েকটা ফ্লোর ফ্যান আছে, যার পাখা অতি দুর্বলভাবে ঘুরছে। আমার চিমশা মুখ দেখে হাসান আমাকে একটু দূরে নিয়ে গলা নামিয়ে বলল, আপনার এবং শাওন ভাবির জন্যে ভালো হোটেলের ব্যবস্থা আছে। অভিনেত্রী মৌসুমী এবং নায়ক মাহফুজ এই হোটেলেই ছিলেন। তারা হোটেল খুব পছন্দ করেছেন।
আমি বললাম, হাসান, আমি এতগুলি মানুষ নিয়ে এসেছি। এরা সবাই আমার অতি আপন। এদেরকে ফেলে হোটেলে যাবার প্রশ্নই আসে না। যে ব্যবস্থা করা হয়েছে আমি তার মধ্যেই থাকব। কোনো সমস্যা নেই।
হাসান বলল, আপনারা দুজন তাহলে শাহীনের শোবার ঘরে থাকুন। ঐ ঘরে এসি আছে।
আমি বললাম, আমি আমার নিজের শোবার ঘরে কাউকে থাকতে দেই না। কাজেই অন্যের শোবার ঘরে আমাদের ঢোকার প্রশ্নই উঠে না। ঢালাও বিছানার ব্যবস্থা করো। সবাই একসঙ্গে থাকব। মজা হবে।
আসন্ন মজার কথা ভেবে আমি উল্লসিত-এরকম ভঙ্গি করলেও মনে মনে চিন্তিত বোধ করলাম শাওনকে নিয়ে। ঘুমুবার জায়গা নিয়ে তার শুচিবায়ুর মতো আছে। সে আমার চেয়েও বিলাসী। তাকে দোষও দিতে পারছি না। সে অতি বড়লোকের মেয়ে।