মাজহার আনন্দিত গলায় আমাকে বলল, ছেলের বুদ্ধি দেখেছেন হুমায়ূন ভাই। পুরা বজরা পাথরের তৈরি, অথচ ছেলে দেখামাত্র বুঝে ফেলেছে এটা পানিতে ভাসে।
এক চায়নিজ শিশু আমাদের দেশের হাওয়াই মিঠাই টাইপ একটা খাবার খেতে খেতে যাচ্ছিল। হঠাৎ অমিয় ছোঁ মেরে তার হাত থেকে এটা নিয়ে নিজে খেতে শুরু করল। আমরা সবাই বিব্রত, শুধু মাজহারের মুখে গর্বের হাসি। মাজহার আমাকে বলল, আমার ছেলের অধিকার আদায়ের চেষ্টাটা দেখে ভালো লাগছে। সাহসী ছেলে। অন্য একজন খাচ্ছে, আমি কেন খাব না! এটাই তার spirit. মাশাল্লাহ।
আমাদের দলে দুটা শিশু। অতি দুষ্ট অমিয়, অতি শিষ্ট আরিয়ানা। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পুরো চায়না ট্রিপে দেখেছি চায়নিজ তরুণীরা অমিয়কে নিয়ে মহাব্যস্ত। তারা আরিয়ানার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। কত মেয়েই না ছোঁ মেরে অমিয়কে কোলে তুলল! কত না অদির! চকলেট গিফট লজেন্স গিফট। অথচ পাশেই পরী শিশুর মতো আরিয়ানা মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে।
মূল বিষয়টা পুরুষ সন্তানের প্রতি চায় নিজদের গভীর প্রীতি। আধুনিক চায়নায় একটির বেশি সন্তান নেয়া যাবে না। আইন কঠিন। সেই একটি সন্তান সবাই চায় পুত্র। কন্যা নয়। যাদের ভাগ্যে কন্যা জোটে, তারা কপাল চাপড়ায় এবং অন্যের পুত্রসন্তানদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে। দুঃখজনক পরিস্থিতি! এই পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। আলট্রাসনোগ্রাফির কারণে গর্ভবতী মায়েরা আগেই জেনে যাচ্ছেন সন্তান ছেলে না মেয়ে। যখনই জীনছেন মেয়ে, গর্ভ নষ্ট করে ফেলছেন। পরের বার যদি পুত্র হয় তখন দেখা যাবে।
গর্ভ নষ্ট বিষয়ে কঠিন আইনকানুন না হলে এক সন্তানের দেশ মহান চীন আগামী একশ’ বছরের নারীশূন্য হয়ে যাবার সম্ভাবনা।
.
স্বর্গ মন্দির (Temple of Heaven)
চীনা সম্রাটরা নিজেদের স্বর্গের পুত্র ভাবতেন। ধুলোমাটির পৃথিবীতে তাদের আসতে হয়েছে ‘প্রজা’ নামক একটা শ্ৰেণীর দেখভালের জন্যে। স্বর্গের পুত্ররা প্রার্থনা করবেন, সেই প্রার্থনা গ্রাহ্য হবে না এটা কেমন কথা?
স্বর্ণ মন্দিরে ভালো ফসল যেন হয় তার জন্যে প্রার্থনা করা হতো। সমস্যা হচ্ছে, স্বর্গ পুত্র প্রার্থনা করছেন তারপরও প্রার্থনা গ্রাহ্য হচ্ছে না, ফসল নষ্ট হচ্ছে, দুর্ভিক্ষ হচ্ছে, এটা কেমন কথা!
স্বর্গ পুত্রদের কাছে এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর আছে। প্রার্থনায় কোনো একটা ত্রুটি হয়েছে। নিয়মকানুন ঠিকমতো মানা হয় নি।
১৯৯৮ সালে UNESCO স্বর্ণ মন্দিরকে World Heritage–এর আওতায় নিয়ে আসে। প্রসঙ্গক্রমে বলি, পাঠকরা কি জানেন বাংলাদেশের একটা জায়গা UNESCO’র World Heritage–এর লিস্টে আছে? যারা জানেন তারা তো জানেনই। যারা জানেন না তাদের জন্যে একটা কুইজ।
হঠাৎ বাংলাদেশের প্রসঙ্গ কেন নিয়ে এলাম? স্বর্গ মন্দির, মিং রাজার কবরখানা নিয়ে ভালো লাগছে না। একটা দেখলেই সব দেখা হয়ে গেল। সব প্রসাদের একই ডিজাইন। একটাই বিশেষত্ব তার বিশালত্ব। সম্রাটরা কখনো ছোটো কোনো চিন্তা করতে পারেন না। আমার প্রাসাদ হবে সবচে’ বড়। দেখে যেন সবার পিলে চমকে যায়। চীনের ডায়ানেস্টিরা পিলে চমকানোর ব্যবস্থাই করেছেন। এর বেশি কিছু না।
রাজা-বাদশার ভোগ বিলাসের আয়োজন দেখে আমি মুগ্ধ হই না, এক ধরনের বিতৃষ্ণা অনুভব করি। এক যুগ আগে যখন চীনে প্রথম এসেছিলাম, তখন মিং সম্রাটের বালিশের মিউজিয়াম দেখেছিলাম। ঘুমুবার সময় তাঁর কয়টা বালিশ লাগত তার সংগ্রহ। এর মধ্যে পিরিচের সাইজের দু’টা গোলাকার বালিশ দেখে প্রশ্ন করেছিলাম-এই বালিশ দুটা কেন?
গাইড বলল, সম্রাটের কানের লতি রাখার বালিশ।
আমি মনে মনে বললাম, মাশাল্লাহ। সম্রাটের কানের লতির গতি হোক। আমি এর মধ্যে নেই।
.
শিক্ষার জন্যে সুদূর চীনে যাও
আমাদের নবী (স.)-র কথা। একজন মওলানা আমাকে বলেছিলেন-এই শিক্ষা ধর্ম শিক্ষা। অন্য কোনো শিক্ষা না। মওলানাকে বলতে পারি নি যে, চীনে ইসলাম ধর্ম গিয়েছে নবীজির মৃত্যুর পর। ধর্ম শিক্ষার জন্যে চীনে যেতে হলে অন্য কোনো ধর্ম শিক্ষার জন্যে যেতে হয়।
যাই হোক, প্রথমবার চীনে গিয়ে একটা মসজিদে গিয়েছিলাম। মসজিদের ভিজিটার্স বুক আছে। ভিজিটার্স বুকে নাম সই করতে গিয়ে দেখি, বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট হুসাইন মুহম্মদ এরশাদ সাহেবও এই মসজিদ দেখেছেন এবং সুন্দর সুন্দর কথা লিখেছেন।
মসজিদেরই ইমাম সাহেবের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তাঁর দু’টা নাম-একটা চায়নিজ নাম, অন্যটা মুসলমান নাম। যখন নামাজ পড়ান বা ধর্মকর্ম করেন, তখন চায়নিজ নাম ব্যবহার করেন।
ইসলাম ধর্মে জীবজন্তুর ছবি আঁকা বা মূর্তি গড়ার অনুমতি নেই। কিন্তু চায়নিজ মসজিদের দেয়ালে এবং মসজিদের মাথায় ড্রাগন থাকবেই। চায়নিজ মুসলমানদের এই বিষয়ে ছাড় দেয়া হয়েছে কিনা জানি না।
নবীজি শিক্ষার জন্যে সুদূর চীনে যেতে বলেছিলেন। আমার ধারণা দূরত্ব বোঝানোর জন্যে তিনি চীনের নাম করেছেন। তবে আক্ষরিক অর্থে বলে থাকলেও চীনের উল্লেখ ঠিক আছে।
প্রাচীন চীন ছিল উদ্ভাবনের স্বর্গভূমি। কম্পাস চীনের আবিষ্কার। বারুদ, কাগজ, ছাপাখানা।
যখন এই লেখা লিখছি, তখন বিশ্বকাপ নিয়ে মাতামাতি হচ্ছে। কেউ কি জানে ফুটবল চীনাদের আবিষ্কার? সং ডায়ানাষ্টির সম্রাট টাইজু ফুটবল খেলছেন এই তৈলচিত্রটি পাঠকদের দেখার জন্যে দেয়া হলো। ফুটবলের তখন নাম ছিল কু জু (Ju ju) অর্থ Kick ball,