চেঙ্গিজ খা বললেন, পারবেন আপনারা বানিয়ে দিতে?
চারজনের মধ্যে তিনজনই বললেন, অবশ্যই পারব। বিশেষ বিশেষ লতাগুল্ম আছে। সময় লাগবে। একেক গুলু একেক সময়ে জন্মায়। তবে পারব। না পারার কিছু নেই।
শুধু একজন বললেন, জরা ও মৃত্যু জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি। একে কিছুতেই আটকানো যাবে না।
চেঙ্গিজ খা সেই চিকিৎসককে বললেন, ধন্যবাদ। বাকি তিনজনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিলেন।
ভালো কথা, আমরা যে তিনজনের পাল্লায় পড়েছিলাম তারা কোন দলের?
পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে যাই। চারশ’ ডলারের ওষুধের বস্তা হাতে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। গাড়ি এবার সত্যি সত্যি গ্রেটওয়ালের কাছে এনে রাখল।
সবার মনে আনন্দ। শুধু আমার এবং কমলের মন ভালো না। কমলের মন ভালো নেই, কারণ মাজহারের চোখ রাঙানির কারণে তার চিকিৎসা হয় নি।
আমার মন ভালো নেই, কারণ আমার চিকিৎসা হয়েছে।
সফরসঙ্গীরা হৈ হৈ করে গ্রেটওয়ালে ছোটাছুটি করছে। তাদের ক্যামেরা বিরামহীনভাবে ক্লিক ক্লিক করছে। গ্রেটওয়াল না, গ্রেটওয়ালের পাশে তাদেরকে কেমন দেখাচ্ছে এটা নিয়েই তারা চিন্তিত।
সবাইকেই অন্যরকম লাগছিল। দিন শেষের সূর্যের আলো পড়েছে তাদের মুখে। বিশাল গ্রেটওয়ার দিগন্তে মিশে আছে, মনে হচ্ছে বিশাল এক নদী। দৃশ্যটা একই সঙ্গে সুন্দর এবং মন খারাপ করিয়ে দেবার মতো।
গ্রেটওয়ালের এক কোনায় দেখি, দানবের মতো সাইজের এক মঙ্গোলিয়ান ঘোড়া দাঁড়িয়ে আছে। ঘোড়ার মালিক ইয়েনের বিনিময়ে দর্শনার্থীদের ঘোড়ায় চড়াচ্ছেন।
গ্রেটওয়াল দেখে যেমন মুগ্ধ হয়েছি ঘোড়া দেখে তেমন মুগ্ধ হলাম। যেন পাথরে তৈরি ভাস্কর্য। নিঃশ্বাস ফেলছে না এমন অবস্থা। আমি এক ঘন্টার চুক্তি করে ঘোড়ায় চড়ে বসলাম। কমল ছুটে এসে বলল, এক-কী হুমায়ূন ভাই, ঘোড়ায় বসে আছেন কেন?
আমি বললাম, ঘোড়া আমার অতি পছন্দের একটি প্রাণী। নুহাশ পল্লীতে আমার দু’টা ঘোড়া ছিল। সে বলল, সবাই গ্রেটওয়ালে ছোটাছুটি করছে, আর আপনি ঝিম ধরে ঘোড়ায় বসে আছেন, এটা কেমন কথা?
আমি নামলাম না। বসেই রইলাম। দুর্ধর্ষ মোঙ্গলরা ঘোড়ার পিঠে চড়ে যখন ছুটে যেত তখন তাদের কেমন লাগত ভাবতে চেষ্টা করলাম।
পাখি উড়ে চলে গেলে পাখির পালক পড়ে থাকে। মোঙ্গলরা নেই, তাদের ভগ্নস্বপ্ন পড়ে আছে।
.
টুরিস্টের চোখে
টুরিস্টদের দেশ ভ্রমণের কিছু নিয়ম আছে। তারা প্রতিটি দর্শনীয় জায়গায় যাবে। যা দেখবে তাতেই মুগ্ধ হবে। মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই, পয়সা উসুল করার ব্যাপার আছে। মুগ্ধ হওয়া মানে পয়সা উসুল হওয়া।
প্রতিটি দর্শনীয় স্থানে তারা কতক্ষণ থাকবে তারও নিয়ম আছে। ক্যামেরায় যতক্ষণ ফিল্ম আছে ততক্ষণ। ফিল্ম শেষ হওয়া মানে দেখা শেষ। আজকাল ডিজিটাল ক্যামেরা বের হয়ে নতুন যন্ত্রণা হয়েছে। এইসব ক্যামেরায় ফিল্ম লাগে না। যত ইচ্ছা ক্যামেরায় ক্লিক ক্লিক করে যাও।
আমরা বেইজিং-এর দর্শনীয় স্থান সবই দেখে ফেললাম।
.
গ্রীষ্ম প্রাসাদ (Summer Palace)
UNESCO ১৯৯৮ সনে সামার প্যালেসকে World Heritage–এর লিস্টে স্থান দিয়েছে। গ্রীষ্ম প্রাসাদ দেখে সবাই মুগ্ধ। মুগ্ধ হবারই কথা। সম্রাটরা রাজকোষ ঢেলে দিয়েছেন নিজের গ্রীষ্ম প্রাসাদ বানাতে। সম্রাটরা গরমে কষ্ট করবেন তা কী করে হয়? গরমের সময় Kuming Lake–এর সুশীতল হাওয়া ভেসে আসে। কী শান্তি।
বিকেলে সম্রাট বা সম্রাট পত্নীর লেকের পাশে হাঁটতে ইচ্ছা হতে পারে। তার জন্যে তৈরি হলো হাঁটার পথ Long Corridor অর্থের কী বিপুল অর্থহীন অপচয়! সম্রাট পত্নী লেকের হাওয়া খাবেন। সহজ ব্যাপার না। সম্রাট পত্নীর কথা লিখলাম, কারণ গ্রীষ্ম প্রাসাদ সম্রাট পত্নী Dawager Cix’র শখ মেটানোর জন্যে ১৮৬০ সনে বানানো হয়।
পাঠকরা কি অনুমান করতে পারবেন গ্রীষ্ম প্রাসাদের মূল অংশ কোনটা? মূল অংশ দীর্ঘজীবী ভবন। যেখানে সম্রাট এবং সম্রাট পত্নীর দীর্ঘজীবনের জন্য মন্ত্র পাঠ করতে হয়। দীর্ঘদিন বেঁচে না থাকলে কে ভোগ করবে? সম্রাটদের জীবনের মূলমন্ত্র তো একটাই–ভোগ।
গ্রীষ্ম প্রাসাদে আমার কাছে ভালো লেগেছে মার্বেলের বজরা। অতি দামি মার্বেলে বিশাল এক বজরা বানিয়ে পানিতে ভাসানোর বুদ্ধি কার মাথায় এসেছিল এটা এখন আর জানা যাবে না। যার মাথায় এসেছিল, তার কল্পনাশক্তির প্রশংসা করতেই হয়।
আগেই বলেছি আমরা বেড়াতে গেছি শীতকালে। কিউমিং লেকের পুরোটাই তখন জমে বরফ। দেখে মনে হবে বরফের জমাট সমুদ্র। সেখানে ছেলেমেয়েরা মনের আনন্দে দৌড়াচ্ছে। শাওনের শখ হলো বরফের উপর হাঁটবে। সে বলল, আমি জীবনে এই প্রথম লেক জমে বরফ হতে দেখলাম। এর উপর হাঁটব না! তাকে আটকালাম। সে বরফের লেকে নামলেই অন্যসব মেয়েরা নামবে। তাদের সঙ্গে বাচ্চারা নামবে এবং অবধারিতভাবে আছাড় খেয়ে কেউ না কেউ কোমর ভাঙবে। শাওন এবং স্বর্ণা দুজনই সন্তানসম্ভবা। তাদের পেটের সন্তানরা মায়ের আছাড় খাওয়াকে ভালোভাবে নেবে-এরকম মনে করার কারণ নেই।
এদিকে অমিয় খুবই যন্ত্রণা করেছে। বানরের মতো বাবার গলা ধরে ঝুলে আছে তো আছেই। গলা ছাড়ছে না। উদ্ভট উদ্ভট আবদারও করছে। তার আবদারে আমরা সবাই মহাবিরক্ত, শুধু মাজহার খুশি। তার ধারণা এতে ছেলের বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ পাচ্ছে। অমিয়’র উদ্ভট আবদারের নমুনা দেই-পাথরের বজরা দেখে সে ঘোষণা করল, এই বজরায় চড়ে সে ঘুরবে। কাজটা এক্ষুণি করতে হবে।