মনে হচ্ছে বড় এক দিঘি। সমুদ্র সৈকত নামের জায়গাটা বস্তিরমতো ঘিঞ্জি। সমুদ্র থেকে একহাত জায়গা ছেড়ে চেয়ারের গায়ে চেয়ার লাগানো চেয়ারের মাথায় ছাতা এক ঘন যে নিচটা অন্ধকার হয়ে আছে। শত শত ফেরিওয়ালা ঘুরছে। কাটা ফল, ভাজা শুঁটকি, ডাব। গা মালিশওয়ালারা তেলের শিশি নিয়ে ঘুরছে। উল্কি আঁকাওয়ালারা ঘুরছে উল্কির জিনিসপত্র নিয়ে। হাটবারের মতো মানুষ। এদের মধ্যে অসভ্য বুড়ো আমেরিকানরা কিশোরী পতিতাদের সবার সামনেই হাতাপিতা করছে। নিজ দেশে এই কাজ করলে তাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যেত। পয়সা খরচ করে মজা পেতে তারা এই দেশে এসেছে। তাদের চোখে এটা প্রসটিটিউটদের দেশ। সব মেয়েই প্রসটিটিউট।
পাতায়া থেকে হাজারগুণ সুন্দর আমার বাংলাদেশের সমুদ্র। কক্সবাজার, টেকনাফ, কুয়াকাটা, সেন্টমার্টিন। আর বেলাভূমি-আহারে কী সুন্দর!
পাতায়া দেখে এই কারণেই আমার মন ভালো হয়ে গেল। একবার মন ভালো হয়ে গেলে সবকিছু ভালো লাগতে শুরু করে। আমি সফরসঙ্গীদের চমকে দিয়ে গায়ের শার্ট খুলে ফেললাম। এইখানেই থামলাম না, গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলাম, পেটে উল্কি আঁকব। আমাদের সামনে হাত-পা ছড়িয়ে বসে থাকা বদ আমেরিকানটাকে দেখিয়ে বললাম, ঐ ব্যাটা পেটে যে ছবি আঁকাচ্ছে সেই ছবি।
সফরসঙ্গী কমল বলল, হুমায়ূন ভাই, ঐ ব্যাটা তো পেটে নেংটা মেয়েমানুষ আঁকাচ্ছে।
আমিও তাই আঁকাব। সেও বুড়ো আমিও বুড়ো।
যখন সফরসঙ্গীরা বুঝল আমি মোটেই রসিকতা করছি না, বাংলাদেশের লেখক ক্ষেপে গেছে তখন বুঝিয়ে সুঝিয়ে রফা করা হলো-আমার পেটে বাঘের মুখের উল্কি আঁকা হবে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার। আমি পেটে বাংলার বাঘ নিয়ে ঘুরব। উল্কি আঁকা হলো। শুরু হলো আমার শ্যামদেশ ভ্রমণ। সন্ধ্যার মধ্যে চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে গেলাম। হোটেলে ফিরে ঘোষণা করলাম, এখানে যা আছে দেখা হয়ে গেছে। যৌনতা প্রদর্শনীর শহর। জীবনের আনন্দ যেখানে অতি স্কুল অর্থ গ্রহণ করেছে।
মাজহার বলল, পাতায়ায় আমাদের আরো তিনদিন থাকতে হবে।
আমি হতভম্ব হয়ে বললাম, কেন?
আমরা প্যাকেজে এসেছি। প্যাকেজে এখানে তিনদিন থাকার কথা।
তিনদিন আমি কী করব?
সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছি। আসলেই তো তিনদিন কী করা যাবে? দ্বিতীয় দিন একই জায়গায় শুরু হলো। একই দৃশ্য। প্রাণহীন সমুদ্র, অতিরিক্ত প্রাণময় ইউরোপের বুড়োর দল। তরুণী থাই মেয়েদের সঙ্গে লটকা লটকিতে যারা অসম্ভব পারঙ্গম।
আমাদের দলে মহিলা আছে দু’জন-শাওন এবং মজহারের স্ত্রী স্বর্ণা। তারা শপিং-এ বের হলো। ফুটপাথ শপিং। তারাও যথেষ্ট বিরক্ত হলো। প্রতিটি দোকানে একই জিনিস। বাংলাদেশের মতো অবস্থা।
একটি জাতির মানসিকতা নাকি তাদের তৈরি খেলনা থেকে পাওয়া যায়। পথের দুপাশে কিছুদূর পরপরই রবারের যৌনাঙ্গ নিয়ে লোকজন বসে আছে। বিক্রি হচ্ছে। অদ্ভূত এই খেলনা দেখে মাজহার পুত্র অমিয় কেনার জন্যে ঘ্যানঘ্যান শুরু করে মা-বাবা দুজনের হাতেই মার খেল। বেচারা মার খাওয়ার কারণ বুঝতে পারল না। তার মন পড়ে রইল অদ্ভুত ঐ খেলনায়।
সন্ধ্যাবেলায় ওয়াকিং স্ট্রিট নামের এক রাস্তার পাশের রেস্টুরেন্টে সবাই বসে আছি। আমি ব্যক্তিগতভাবে শঙ্কিত আরো দু’রাত কাটাতে হবে এই ভেবে, মন থেকে শঙ্কা দূর করে আনন্দে আছি এমন এক ভাব করার চেষ্টা করছি। আমাদের একজন সফরসঙ্গী আর্কিটেক্ট ফজলুল করিম শুধু অনুপস্থিত। বেচারার মন খারাপ তার স্ত্রী তাকে ছেড়ে গেছে। স্ত্রীকে নিয়ে এই পাতায়াতে সে অনেকবার এসেছে। এবার সে এসেছে একা। বাকি সবাই এসেছে সস্ত্রীক। ব্যক্তিগত পারিবারিক আনন্দ থেকে বঞ্চিত। প্রায়ই দেখি সে দল ছেড়ে একা ঘুরছে। আমাদের খারাপই লাগে। আজ সে আমদেরকে চমকে দিয়ে হাসিমুখে উপস্থিত হলো আর সঙ্গে অতি রূপবতী এক থাই কন্যা। মায়াময় চোখ। উজ্জ্বল গাত্রবর্ণ। মাথাভর্তি ঘন কালো চুল।
জানা গেল, করিম এই বান্ধবী জোগাড় করেছে। সে এখন থেকে করিমের সঙ্গেই থাকবে। প্রতিরাতে তাকে পাঁচশ বাথ দিতে হবে।
আমি অবাক হয়ে মেয়েটির নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দলের সবাই মেয়েটির সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার করল। আমরা ভাব করলাম যেন সে করিমের দীর্ঘদিনের চেনা কোনো তরুণী। কিছুটা সময় আমাদের সঙ্গে কাটাতে এসেছে। মেয়েটিও সহজ-স্বাভাবিক। ছয়মাসের অন্বয়কে কোলে নিয়ে আদর করছে। গল্প করছে।
এর মধ্যে মাজহার পুত্র এক খেলনা কিনে নিয়ে এল। রিমোট কন্ট্রোলের গাড়ি। কিছুক্ষণ চলে, তারপর তালগোল পাকিয়ে যায়, আবার চলে। সবাই খেলনা দেখে মজা পাচ্ছি। থাই মেয়েটি জানতে চাইল, খেলনার দাম কত? মাজহার বলল, পাঁচশ’ বাথ।
মেয়েটি ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজিতে বলল, Me and Toy same same 500 bath.
সরল বাংলায়-এই খেলনার সঙ্গে আমার কোনো প্রভেদ নেই। আমি এবং খেলনা একই মূল্য, পাঁচশ’ বাথ।
পাতায়া ভ্রমণ শেষে আমরা থাইল্যান্ডের অনেক সুন্দর জায়গায় গিয়েছি। এক হাজার এক প্রাকৃতিক লীলা সৌন্দর্যের ছটা দেখেছি। বইয়ে ক্রস মার্ক দিয়েছি। কিছুই কেন জানি আমাকে স্পর্শ করল না। কানে সারাক্ষণ থাই মেয়েটির করুণ গলা রেকর্ডের মতো বাজতে থাকল–Me and toy sarne same. মানবজীবনের কী করুণ পরাজয়!
চন্দ্রযাত্রা
একটা ধাঁধা দিয়ে শুরু করি। চার অক্ষরে নাম এমন এক দেশ, যে নামে শুনলেই বাংলাদেশের মতো অনেক দেশের মানুষের চোখ চকচক করতে থাকে। হিন্টস দিচ্ছি-আ দিয়ে শুরু। শেষ অক্ষর কা।