মেয়েদের মধ্যে টেনশন এবং উত্তেজনা। মেকাপ ঠিক করা দরকার। সেই সুযোগ কি আছে?
চায়নিজ ভদ্রলোক (চেহারা অবিকল অভিনেতা ব্রুসলির মতো) বড় সাইজের একটা ঝিনুক তুলে আমাকেই প্রথম জিজ্ঞেস করলেন, বলে এর ভেতর কটা মুক্তা?
একটা ঝিনুকে একটাই মুক্ত থাকার কথা। এরকমই তো জানতাম। আমি বললাম, একটা।
সফরসঙ্গীরা আমাকে নানান বিষয়ে জ্ঞানী ভাবে। তারা মনে করল এটাই সত্যি উত্তর। প্রত্যেকেই বলল, একটা শুধু বলেই ক্ষান্ত হলো না, জ্ঞানীর হাসিও হাসল। যে হাসির অর্থ-কী ধরা তো খেলে! এখন দাও সবাইকে একটা করে মুক্তা।
সফরসঙ্গীদের মধ্যে শুধু চ্যালেঞ্জার বলল, সতেরোটা। চ্যালেঞ্জারের বোকামিতে আমরা সবাই যথেষ্ট বিরক্ত হলাম।
ঝিনুক খোলা হলো। ঝিনুক ভর্তি মুক্তা। মুক্তা গোনা হলো এবং দেখা গেল মুক্তার সংখ্যা ১৭। কাকতালীয় এই ঘটনার ব্যাখ্যা আমি জানি না। আমি আমার এক জীবনে অনেক কাকতালীয় ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। এটি তার একটি। চ্যালেঞ্জারকে একটা বড়সড় মুক্তা দেয়া হলো। সঙ্গে সঙ্গে চ্যালেঞ্জারের চোখে পানি। তার চোখের অশ্রু গ্লান্ডে মনে হয় কোনো সমস্যা আছে, সে কারণে এবং সম্পূর্ণ অকারণে চোখ থেকে এক দেড় লিটার পানি ফেলতে পারে।
শ্রেষ্ঠ রূপবতীর পুরস্কার পেল শাওন। সে এমন এক ভঙ্গি করল যেন শেষ মুহূর্তে সে বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় রানার্স আপকে পরাজিত করে সোনার মুকুট জিতে নিয়েছে।
কমল তার স্ত্রীর উপর খুব রাগ করল, ধমক দিয়ে বলল, কোথাও বেড়াতে গেলে সাজগোজ করে বের হবে না? ঢাকা থেকে তো দুনিয়ার সাজের জিনিস নিয়ে এসেছ, এখন ঘুরছ ফকিরনীর মতো।
মুক্তা বিষয়ক জটিলতা শেষ করে বাস ছুটছে গ্রেটওয়ালের দিকে। একসময় থামল। আমরা কৌতূহলী হয়ে তাকালাম। কোথায় গ্রেটওয়ালঃ চায়নিজ হার্বাল মেডিসিনের বিশাল দালান। হার্বাল বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে না-কি হার্বাল মেডিসিনের কিংবদন্তি ডাক্তারেরা আমাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করবেন। শুধু ওষুধপত্র নগদ ডলারে কিংবা ক্রেডিট কার্ডে কিনতে হবে।
.
ভেষজ বিশ্ববিদ্যালয় বনাম বাংলাদেশের কয়েকজন গবেই
ভেষজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বাস থেমেছে, আমরা হৈচৈ করে নামছি। ওমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মকর্তা ছুটে এলেন। চাপা গলায় নিখুঁত ইংরেজিতে বললেন, বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। ক্লাস চলছে, অধ্যাপকরা গবেষণা করছেন। হৈচৈ চলবে না। পিন পাতনিক নৈঃশব্দ্য বজায় রাখতে হবে।
আমরা গেলাম ঘাবড়ে। মায়েরা নিজেদের বাচ্চাদের মুখ চেপে ধরলেন। এ কী ঝামেলা! রওনা হয়েছি গ্রেট ওয়াল দেখতে, এ কোন চক্করে এসে পড়লাম?
বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তা আমাদের হলঘরের মতো ঘরে দাঁড় করিয়ে কোথায় যেন চলে গেলেন। হলঘরের চারপাশে নানান ধরনের ভেষজ গাছ। প্রতিটির গায়ে চায়নিজ নাম, বোটানিকেল নাম। দুটি গাছ চিনলাম। একটি আমাদের অতিপরিচিত ঘৃতকুমারী,, অন্যটা জিনসেং, যৌবন ধরে রাখার ওষুধ। দেয়ালে বিশালাকৃতির ছবি। একটিতে মাও সে তুং ভেষজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করছেন। অন্য একটিতে World Health Organization–এর প্রধানের সঙ্গে হাসি হাসি মুখে কী যেন আলোচনা করছেন। বিদেশী যেসব ছাত্র-ছাত্রী ভেষজ বিদ্যা শিখতে এসেছে তাদের ছবিও অাছে।
হলঘরের এক প্রান্তে অতি বৃদ্ধ এক চায়নিজের মর্মর পাথরের মূর্তি। ভারতবর্ষের ভেষজ বিজ্ঞানের জনক যেমন মহর্ষি চরক, এই চায়নিজ বৃদ্ধও (নাম মনে নেই) চৈনিক ভেষজ বিজ্ঞানের জনক। সফর সঙ্গীরা চৈনিক ভেষজ বিজ্ঞানীরা সামনে নানান ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। আমি ভাবছি কখন এই চক্কর থেকে উদ্ধার পাব।
মিনিট পাঁচেক পার হলো, এক অতি স্মার্ট তরুণী ঢুকল। সে পোশাকে স্মার্ট। ইংরেজি কথা বলায় স্মার্ট। পুরো চীন ভ্রমণে আমার দেখা মতে সবচে’ স্মার্ট তরুণী। সে আমাদের একটি সুসংবাদ দিল।
সুসংবাদটা হচ্ছে, ভেষজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাজ্ঞানী চিকিৎসকরা বিনামূল্যে আমাদের শরীরের অবস্থা দেখতে রাজি হয়েছে। আমরা যে অতি দূরদেশ থেকে এখানে এসেছি, ভেষজ চিকিৎসা সম্পর্কে আগ্রহ দেখাচ্ছি, তার কারণেই আমাদের প্রতি এই দয়া।
আমরা কৃতজ্ঞতায় ছোট হয়ে গেলাম এবং ভেষজ চিকিৎসকদের মহানুভবতায় হলাম মুগ্ধ ও বিস্মিত।
আমাদের একটা ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হলো। স্মার্ট তরুণী ব্যাখ্যা করলেন আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র, বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক, কী করে আমাদের জীবনীশক্তি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিচ্ছে। ভেষজ বিজ্ঞানই আমাদের একমাত্র পরিত্রাতা। তিনি জানালেন, তিনজন চিকিৎসক একসঙ্গে ঘরে ঢুকবেন। তারা কেউ চৈনিক ভাষা ছাড়া কিছুই জানেন না। সবার সঙ্গে একজন করে ইন্টরপ্রেটার থাকবে।
মহান চিকিৎসকরা আমাদের মল-মূত্র কফ কিছুই পরীক্ষা করবেন না। নাড়ি দেখে সব বলে দেবেন।
আমরা আবারো অভিভূত।
নাড়ি দেখে রোগ নির্ণয় বিষয়ে তারাশংকরের বিখ্যাত উপন্যাস আছে আরোগ্য নিকেতন। সেই উপন্যাসের আয়ুর্বেদশাস্ত্রী কবিরাজ নাড়ি দেখে মৃত্যুব্যাধি ধরতে পারতেন। আমার ভেতর রোমাঞ্চ হলো এই ভেবে যে, উপন্যাসের একটি চরিত্র বাস্তবে দেখব।
স্মার্ট তরুণী বললেন, মহান ভেষজবিদের সম্বন্ধে শেষ কথা বলে বিদায় নিচ্ছি। আধুনিক ডাক্তাররা নাড়ি ধরে শুধু Pulse beat শোনে। আমাদের মহান শিক্ষাগুরু নাড়ি ধরেই হার্ট, লিভার, কিডনি এবং রক্ত সঞ্চালন ধরেন। প্রাচীন চৈনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের এই হলো মহত্ত্ব। এই বিদ্যা হারিয়ে যাচ্ছিল, আমাদের ভেষজ বিশ্ববিদ্যালয় তা পুনরুদ্ধার করেছে। আপনারা কি এই আনন্দ সংবাদে হাততালি দিবেন?