আমি ঠাট্টা করছি না, সারাদিনের বিশ্রামের কারণে সব মেয়ের পা ফুলে গেল। তারা ঠিক করল ফুট ম্যাসাজ করাবে। হোটেলের কাছেই বিশাল ম্যাসাজ পার্লার।
ম্যাসাজের বিষয়টা এবার দেখছি। এক যুগ আগে ম্যাসাজ পার্লার চোখে পড়ে নি। আধুনিক চীনের অনেক রূপান্তরের এটি একটি। আমাদের হোটেল থেকে ম্যাগডোনাল্ড রেস্টুরেন্টের দূরত্ব দশ মিনিটের হাঁটা পথ। এরমধ্যে চারটা ম্যাসাজ পার্লার। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ম্যাসাজ পার্লারে মাসাজ নিচ্ছে চায়নিজরাই। কঠিন পরিশ্রমী চৈনিক জাতি গী টেপাটেপির ভক্ত হয়ে পড়েছে। মাও সে তুঙ-এর মাথায় নিশ্চয়ই এই জিনিস ছিল না।
রাস্তায় প্রসটিটিউটরাও নেমেছে। রূপবতী কন্যারা বিশেষ এক ধরনের কালে পোশাক পরে নির্বিকার ভঙ্গিতে ঘুরছে। কেউ তাদেরকে নিয়ে বিব্রত বা চিন্তিত না। এমন একজনের পাল্লায় আমি নিজেও একদিন পড়েছিলাম। ঘটনাটা বলি, বাংলাদেশ অ্যাম্বেসির ফার্স্ট সেক্রেটারি আমাকে বইয়ের দোকানে নিয়ে যাচ্ছেন। দু’জন গল্প করতে করতে এগুচ্ছি, হঠাৎ কালো পোশাকের এক তরুণী এসে আমার হাত ধরল। আমি বিস্মিত হয়ে তাকালাম। রূপবতী এক তরুণী। মায়া মায়া চেহারা। সে আদুরে গলায় বলল, আমাকে তুমি তোমার হোটেলে নিয়ে চল। আমি ম্যাসাজ দেব। বলেই চোখে কুৎসিত ইশারা করল। এমন নোংরা ইশারা চোখে করা যায় আমার জানা ছিল না। আমি হতভম্ব।
মনিরুল হক ধমক দিয়ে মেয়েটিকে সরিয়ে বিরক্ত গলায় বললেন, বর্তমান চীনে এই বিষয়টা খুব বেড়েছে। আমি বললাম, পুলিশ কিছু বলে না? মনিরুল হক বললেন, না।
পার্ল এস বাকের ‘গুড আর্থের চীন এবং বর্তমান চীন এক না। এই দেশ আরো অনেকদূর যাবে। ক্ষমতায় ও শক্তিতে পাল্লা দেবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। মানুষ বদলাবে, মূল্যবোধ বদলাবে। ঘরের দরজা-জানালা খুলে দিলে আলো-হাওয়া যেমন ঢোকে-কিছু মশা-মাছিও ঢোকে। মহান চীন তার দরজা-জানালা খুলে দিয়েছে। আলো-হাওয়া এবং মশা-মাছি ঢুকছে।
মূল গল্পে ফিরে আসি। পরের দিন গ্রেটওয়াল দেখতে যাবার কথা, যাওয়া হলো না, কারণ সফরসঙ্গীরা যে যার মতো মার্কেটে চলে গেছে। সবাই বলে গেছে এক ঘন্টার মধ্যে ফিরবে। তারা ফিরল সন্ধ্যায়। প্রত্যেকের হাতভর্তি ব্যাগ। মুখে বিজয়ীর হাসি।
শেষ পর্যন্ত গ্রেটওয়াল দেখা হলো। সেও এক ইতিহাস। বাবস্থা করল এক টুর কোম্পানি। তারা গ্রেটওয়াল দেখাবে। ফাও হিসেবে আরো কিছু দেখাবে ফ্রি। জনপ্রতি ভাড়া একশ’ ডলার। সেখানেও দরাদরি। কী বিপদজনক দেশে এসে পৌঁছলাম! একেকবারে আমরা বলছি-”না, পোষাচ্ছে না।’ বলে চলে আসার উপক্রম করতেই তারা বলে, “একটু দাঁড়াও, ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে কথা বলে দেখি। তারা চ্যাও টু করে কিছুক্ষণ কথা বলে, তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলে, ‘ম্যানেজমেন্ট আরো দু’ডলার করে কমাতে রাজি হয়েছে।
শেষ পর্যন্ত ১০০ ডলার ভাড়া কমিয়ে আমরা ত্রিশ ডলারে নিয়ে এলাম। বাচ্চাদের টিকিটি লাগবে না। তারা ফ্রি। ট্যুর কোম্পানির রূপবতী অপারেটর নিচু গলায় বলল, তোমাদের যে এত সস্তায় নিয়ে যাচ্ছি খবরদার এটা যেন অন্য টুরিস্টরা না জানে! জানলে কোম্পানি বিরাট বিপদে পড়ে যাবে।
টুর কোম্পানির বাসে উঠার পরে জানলাম, ট্যুরিস্টরা যাচ্ছে বিশ ডলার করে। একমাত্র আমরা ত্রিশ ডলার। অস্ট্রেলিয়ার এক গাধা সাহেব-মেম শুধু একশ’ ডলার করে টিকিট কেটেছে। অস্ট্রেলিয়ার সেই গাধা দম্পত্তির সঙ্গে আমরা ভালো খাতির হয়েছিল। আমরা একসঙ্গে চায়নিজ হার্বাল চিকিৎসা নিয়েছি, সেই প্রসঙ্গে পরে আসব।
কোম্পানির বাস সরাসরি আমাদের গ্রেটওয়ালে নিয়ে গেল না। জেড তৈরির এক কারখানায় এন ছেড়ে দিল। যদি আমরা জেডের তৈরি কিছু কিনতে চাই। টুর কোম্পানির সঙ্গে জেড কারখানার বন্দোবস্ত করা আছে। টুর কোম্পানি যাত্রীদের এনে এখানে ছেড়ে দেবে। কিছু ব্যবসা-বাণিজ্য হবে। বিনিময় কমিশন।
পাঠকদের মধ্যে যারা আগ্রার তাজমহল দেখেছেন, তারা এই বিষয়টি জানেন। তাজমহল দর্শনার্থীরা সরাসরি তাজ দেখতে যেতে পারেন না। তাদেরকে মিনি তাজ বলে এক বস্তু প্রথমে দেখতে হয়। সেখানকার লোকজন সবাই কথাশিল্পী। তাদের কথার জালে মুগ্ধ হয়ে মিনি তাজ কিনতে হয়। সেই মিনি তাজ আজ পর্যন্ত কেউ অক্ষত অবস্থায় বাংলাদেশে আনতে পারেন নি। বর্ডার পার হবার আগেই অবধারিতভাবে সেই তাজ ভেঙে কয়েক টুকরা হবেই।
জেড এম্পোরিয়াম থেকে কেনাকাটা শেষ করে বাসে উঠলাম, ভাবলাম এইবার বোধহয় গ্রেটওয়াল দেখা হবে। ঘণ্টাখানিক চলার পর বাস থামল আরেক দোকানে। এটা না-কি সরকার নিয়ন্ত্রিত মুক্তার কারখানা। ঝিনুক চাষ করা হয়। ঝিনুক থেকে মুক্তা বের করে পালিশ করা হয়-নানান কর্মকাণ্ড।
একজন মুক্তা বিশেষজ্ঞ সব টুরিস্টকে একত্র করে মুক্তার উপর জ্ঞানগর্ভ ভাষণ দিলেন। মুক্তার প্রকারভেদ, ঔজ্জল্য, এইসব বিষয়ে পরিপূর্ণ জ্ঞান দান করে তিনি ঘোষণা করলেন-এইবার আপনাদের সামনে আমি একটা ঝিনুক খুলব। আপনারা অনুমান করবেন ঝিনুকের ভেতর মুক্তার সংখ্যা কত। যার অনুমান সঠিক হবে তাকে আমাদের পক্ষ থেকে একটা মুক্ত উপহার দেয়া হবে। এইখানেই শেষ না, আপনাদের ভেতর যেসব মহিলা টুরিষ্ট আছেন তাদের মধ্যেও প্রতিযোগিতা। সবচে’ রূপবতীকেও একটা মুক্তা উপহার দেয়া হবে।