চীনের ইতিহাস বলে মোট পাঁচ দফায় প্রাচীর তৈরি হয়। প্রথম শুরু হয় জিন ডায়ানেস্টির আমলে (Qin Dynasty), যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ২০৮ বছর আগে। বর্তমানে যে প্রাচীর আছে তা তৈরি হয় সম্রাট হংথু (মিং ডায়ানেস্টি, ১৩৬৮ সন)–এর শাসনকালে। শেষ করেন সম্রাট ওয়ানলি (মিং ডায়ানেস্টি, ১৬৪০)।
প্রাচীরের গড় উচ্চতা ২৫ ফিট। তিন লক্ষ শ্রমিকের তিনশ বছরের অর্থহীন শ্ৰম। কোনো মানে হয়? কোনো মানে হয় না। মানব সম্পদের এই অপচয় সম্রাটরাই করতে পারেন। রাজা-বাদশাদের কাছে সাধারণ মানুষের জীবন সব সময়ই মূল্যহীন ছিল।
আমরা আজ যাব দীর্ঘতম কবরখানা দেখতে। চীনের পরিচয় চীনের দেয়াল। সেই দেয়াল দেখা সহজ বিষয় না। আমার সফরসঙ্গীদের আনন্দ উত্তেজনায় টগবগ করার কথা। তারা কেমন যেন ঝিমিয়ে আছে। গা ছাড়া ভাব। কারণটা ধরতে পারলাম না।
এক পর্যায়ে মাজহর কাঁচুমাচু হয়ে বলল, গ্রেটওয়াল দেখার প্রোগ্রামটা আরেকদিন করলে কেমন হয়!
আমি বললাম, আজ অসুবিধা কী?
কোনো অসুবিধা নেই। গতকাল ফরবিডেন সিটি দেখে সবাই টায়ার্ড। আজকে বিশ্রাম করতে পারলে ভালো হতো। মেয়েরা বিশেষ করে কাহিল হয়ে পড়েছে। নড়াচড়াই করতে পারছে না।
আমি বললাম, মেয়েরা যেহেতু ক্লান্ত তারা অবশ্যই বিশ্রাম করবে। গ্রেটওয়াল পালিয়ে যাচ্ছে না।
মাজহারের মুখ আনন্দে ঝলমল করে উঠল। একই সঙ্গে মেয়েদের মুখেও হাসি। একজন বলে ফেলল, দেরি করে লাভ নেই, চল রওনা দেই।
আমি বললাম, তোমাদের না রেস্ট নেবার কথা, যাচ্ছ কোথায়?
মেয়েদের মুখপাত্র হিসেবে মাজহার বলল, সিল্ক মার্কেটে টুকটাক মার্কেটিং করবে। মেয়েদের মার্কেটিং মানেই বিশ্রাম।
মেয়েরা বিপুল উৎসাহে বিশ্রাম করতে বের হলো। দুপুর দু’টা পর্যন্ত এই দোকান থেকে সেই দোকান, দোতলা থেকে সাততলা, সাততলা থেকে তিনতলা, তিনতলা থেকে আবার ছয়তলা করে বিশ্রাম করল। প্রত্যেকের হাতভর্তি নানান সাইজের ব্যাগ। দুপুরে দশ মিনিটের মধ্যে লাঞ্চ শেষ করে আবার বিশ্রামপর্ব শুরু হলো।
সিল্ক মার্কেটের যত আবর্জনা আছে, তার বেশির ভাগ আমরা কিনে ফেললাম। মেয়েরা দরদাম করতে পারছে এতেই খুশি। কী কিনছে এটা জরুরি না। আমি একবার ক্ষীণ স্বরে বললাম, যা কিনছ সবই ঢাকায় পাওয়া যায়। সবাই আমার কথা শুনে এমনভাবে তাকাল যেন এত অদ্ভুত কথা কখনো তারা শোনেনি।
আমি ক্লান্ত, এবং হতাশ। রাত দশটার আগে কারো বিশ্রাম শেষ হবে এমন মনে হলো না। বিশ্রামপর্ব দশটায় শেষ হবে, কারণ সিল্ক রোড বন্ধ হয়ে যাবে।
আমি কী করব বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ মেয়েদের কেনাকাটা দেখলাম। এর মধ্যে এরা কিছু চায়নিজও শিখে নিয়েছে। দোকানি বলছে, ইয়ি বাই। আরা লছে, উয়ু। জিজ্ঞেস করে জানলাম ‘ইয়ি বাই’ হলো একশ’, আর ‘উয়ু হলো পাচ। মেয়েদের বিদেশী ভাষা শেখার ক্ষমতা দেখে বিস্মিত হয়ে নিজের মনে কিছুক্ষণ ঘুরলাম। একদিকে শিল্পীদের মেলা বসেছে। একজন হাতের বুড়ো আঙুলে চায়নিজ ইংক লাগিয়ে নিমিষের মধ্যে অতি অপূর্ব ছবি বানাচ্ছেন। আমার আগ্রহ দেখে তিনি আমার আঙুলে কালি লাগিয়ে কাগজ এগিয়ে দিলেন। আমি অনেক চেষ্টা করেও কিছু দাঁড়া করতে পারলাম না। শিল্পী যেমন আছে ভাস্কর ও আছে। সিল্ক মার্কেটের এক কোনায় দেখি এক চাইনিজ বুড়ো একদলা মাটি নিয়ে বসে আছে। দুশ’ ইয়েনের বিনিময়ে সে মাটি দিয়ে অবিকল মূর্তি বানিয়ে দেবে। তার সামনে বিশ মিনিট বসলেই হবে। বিশ মিনিট বসে বিশ্রাম নেবার সুযোগ পাওয়া যাবে ভেবেই বসলাম। একজন ভাস্কর কীভাবে কাজ করে তা দেখার আগ্রহ তো আছেই।
বৃদ্ধ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ আমাকে দেখে অতিদ্রুত মাটি ছানতে শুরু করল। কুড়ি মিনিটের জায়গায় আধঘন্টা পার হলো। মূর্তি তৈরি। আমি বললাম, কিছু মনে করো না, মূর্তিটা আমার না। চায়নিজ কোনো মানুষের।
মূর্তির চোখ পুতি পুতি। নাক দাবানো।
বুড়ো বলল, তোমার চেহারা তো পুরোপুরি চায়নিজদের মতো।
আমি বললাম, তাই না–কি?
বুড়ো বলল, অবশ্যই।
আশেপাশের সবাই বুড়োকে সমর্থন করল। আমিও নিশ্চিত হলাম আমার চেহাৱা চৈনিক। ইতিমধ্যে শাওন চলে এসেছে। তার কাছে ইয়েন যা ছিল সব শেষ। আমাকে যেতে হবে ডলার ভাঙাতে। সে বলল, তুমি চায়নিজ এক বুড়োর মূর্তি হাতে নিয়ে বসে আছে কেন?
আমি গম্ভীর গলায় বললাম, চায়নিজ বুড়ো তোমাকে কে বলল? এটা আমার নিজের ভাস্কর্য। উনি বানিয়েছেন। উনি একজন বিখ্যাত ভাস্কর।
কত নিয়েছে?
দুশ’ ইয়েন।
আমাকে ডাকলে না কেন? আমি পঁচিশ ইয়েনে ব্যবস্থা করতাম।
বলেই সে দেরি করল না, দরাদরি শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবাক হয়ে দেখি, আমাদের মহান ভাস্কর ত্রিশ ইয়েনে শাওনের মূর্তি বানাতে রাজি হয়েছেন।
শাওন বলল, তুমি ডলার ভাঙিয়ে নিয়ে এসো, ততক্ষণ উনি আমার একটা মূর্তি বানাবেন। আমার খানিকক্ষণ রেষ্টও হবে। পা ফুলে গেছে।
ডলার ভাঙিয়ে ফিরে এসে দেখি, মহান ভাস্কর চায়নিজ এক মেয়ের মূর্তি বানিয়ে বসে আছেন। শাওন খুশি। মূর্তির কারণে না। শাওন খুশি কারণ মহান ভাস্কর তার মোটা নাককে শাওনের অনুরোধে খাড়া করে দিয়েছেন। চেহারা চায়নিজ মেয়েদের মতো হলো না তো খাড়া হয়েছে।
আমরা হোটেলে ফিরলাম রাত আটটায়। কে কী কিনল সব ডিসপ্লে করা হলো। সবার ধারণা হলো তারা যা কিনেছে সেটা ভালো না। অন্যদেরটা ভালো। মাজহারের মুখ হঠাৎ অন্ধকার হয়ে গেল। একটু আসছি’ বলে সে বের হয়ে গেল। ফিরল রাত দশটায়। শাওন কিছু মুখোশ কিনেছে, যেগুলি সে কিনে নি। মাজহার গিয়েছিল ঐগুলি কিনতে।