অ্যাম্বেসির বিষয়টা বলি। একজন লেখক বুন্ধুবান্ধব নিয়ে বেড়াতে যাবে, তার জন্যে অ্যাম্বেসি গাড়ি পাঠাবে বাংলাদেশ অ্যাম্বেসি এই জিনিস না। লেখক কবি সাহিত্যিক-পেইন্টার তাদের কাছে কোনো বিষয় না। প্রবাসে যেসব বাংলাদেশী বাস করেন, তারাও তাদের কাছে কোনো বিষয় না। অ্যাম্বেসি দেখে বেড়াতে আসা মন্ত্রী-মিনিস্টারদের, আমলাদের। সেইসব মহামানবরা অ্যাম্বেসির গাড়ি নিয়ে শপিং করেন। অ্যাম্বেসির কর্মকর্তারা বাজারসদাই-এ সহায়তা করেন।
পৃথিবীর বাকি দেশগুলির অ্যাম্বেসির অনেক কর্মকাত্রে প্রধান কর্মকাণ্ড, তাদের সংস্কৃতির সঙ্গে অন্যদের পরিচয় করিয়ে দেয়া। এত সময় বাংলাদেশ অ্যাম্বেসির কর্মকর্তাদের নেই। তাদেরকে নানান স্টেট ফাংশনে ডিনার খেতে হয়। অনেকগুলি পত্রিকা পড়তে হয় (দেশে কী হচ্ছে জানার জন্যে। সময়ের বড়ই অভাব।
আমি কখনো দেশের বাইরে গেলে অ্যাম্বেসির সঙ্গে যোগযোগ করে যাই না। আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়। বেইজিং-এ অ্যাম্বেসিকে আগেভাগে জানানোর কাজটি করেছে মাজহার। যে লোক অ্যাম্বেসি থেকে এসেছেন তিনি যে অ্যাম্বাসেডর কর্তৃক নির্দেশ পেয়ে এসেছেন তাও না। তিনি এসেছেন, নিজের আগ্রহে এবং আনন্দে। তিনি লেখক হুমায়ূন আহমেদের অনেক বই পড়েছেন, অনেক নাটক দেখেছেন। লেখককে সামনাসামনি দেখার ইচ্ছাই তার মধ্যে কাজ করেছে।
এই সৌভাগ্য আমার প্রায়ই হয়। অ্যাম্বেসিতে সিরিয়াস কিছু ভক্ত পাওয়া যায়। তারা যে আগ্রহ দেখায় তার জন্যে ও সমস্যায় পড়তে হয়। ১৯৯৬ সালে বিশাল এক দল নিয়ে নেপালের কাঠমান্ডুতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। অ্যাম্বেসিতে মোটামুটি হুলস্থুল পড়ে গেল। অ্যাম্বেসিতে তিনটি ডিনার দিল। কাঠমাণ্ডুর লেখক শিল্পীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ব্যবস্থা করল। আমি বিব্রত (এবং খানিকটা আনন্দিতও)। সমস্যা দেখা দিল তারপর যখন বাংলাদেশ অ্যাম্বেসি আমার এবং আমার দলের পেছনে বিরাট অঙ্কের খরচ দেখাল। খরচের হিসাব চলে গেল জাতীয় সংসদে। শাওনের মা, বেগম তহুরা আলি তখন সংসদ সদস্য। তাঁর কাছেই সংসদের আলোচনার কথা শুনলাম। খুবই লজ্জা পেলাম।
কাজেই আমি অ্যাম্বেসির তরুণ সুদর্শন হাস্যমুখি ফার্স্ট সেক্রেটারিকে শক্তভাবে বললাম, আপনি যে কষ্ট করেছেন তার জন্যে ধন্যবাদ। তবে আপনার কাছ থেকে আর কোনো সাহায্য-সহযোগিতা আমি নেব না। আপনাদের কারো বাড়িতে ডিনার খাব না, অ্যাম্বাসেডর সাহেবের সঙ্গে দেখা করব না।
মনিরুল হক অতি বিনয়ের সঙ্গে বললেন, আপনি যা বলবেন তাই।
মনিরুল হক তাঁর কথা রাখেন নি। তিনি তাঁর বাড়িতে বিশাল খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে আমাদের অ্যাম্বাসেডরও উপস্থিত ছিলেন। তিনি আমার সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, পৃথিবীর সংস্কৃতি চর্চা, ধর্ম নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ (এবং শিক্ষনীয়) বিষয়ে আলোচনা করলেন। এই আলোচনায় আমার সফরসঙ্গীরা উপকৃত হয়েছে বলে মনে হয়। কারণ তারা গভীর আগ্রহে আলোচনা শুনল।
দেশে ফেরার সময় মনিরুল হক সাহেব কাঁচুমাচু হয়ে একটা প্রস্তাব দিলেন। অ্যাম্বাসেডর সাহেব ফরেন সেক্রেটারির জন্য উপহার হিসেবে একটা গলফ সেট পাঠাবেন। গলফ সেটটা অত্যন্ত দামি বিধায় লাগেজে দেয়া যাচ্ছে না। হাতে করে নিয়ে যেতে হবে। আমরা কি নিয়ে যাব? একবার ঢাকায় পৌঁছলে আমাদের আর কিছুই করতে হবে না। সেক্রেটারি সাহেব লোক পাঠিয়ে নিয়ে যাবেন।
আমি গলফ সেট কাঁধে করে নিয়ে যেতে খুবই রাজি ছিলাম। আমার সফরসঙ্গীরা বাদ সাধল। তারা মনে করল, এতে লেখক হুমায়ূন আহমেদের সম্মানহানি হবে। গলফ সেট নেয়া হলো না।
আমাদের পররাষ্ট্র সচিবের কাছে এতদিনে নিশ্চয়ই গলফ সেট পৌঁছে গেছে। আশা করি, গলফে তার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। আমরা মন্ত্রী, সচিব এবং এ্যাম্বাসেডরদের সর্ব বিষয়ে উন্নতি কামনা করি।
বেইজিং-এ আমাদের জন্যে যে হোটেল ঠিক করা ছিল, তার নাম Gloria Plaza. চমঙ্কার হোটেল। সামনেই ক্রিসমাস, এই উপলক্ষে সুন্দর করে সাজানো। বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা, ভেতরে চমৎকার উষ্ণতা। ডেস্কের চায়নিজ মেয়েরা সুন্দর ইংরেজি বলছে। ব্যবহার আন্তরিক। এক যুগ আগের দেখা চীন এবং বর্তমানের আধুনিক চীনের কোনো মিল নেই।
আমাদের হোটেলে দাখিল করে মনিরুল হক সাহেব কয়েকটা টিপস দিলেন। প্রথম টিপস, কেনাকাটা করতে গেলেই দামাদামি করতে হবে। এখানকার দোকানপাট ইউরোপ-আমেরিকার মতো না-যে দাম লেখা থাকবে সেই দামেই সোনামুখ করে কিনতে হবে। চায়নিজ দোকানিরা জিনিসপত্রের গায়ে আকাশছোঁয়া দাম লিখে রাখে, কাজেই শুরু করতে হবে পাতাল থেকে। যে বস্তুর গায়ে লেখা পাঁচশ’ ইয়েন, তার দাম বলতে হবে পাঁচ ইয়েন। কিছুক্ষণ দরদাম করার পর দশ ইয়েনে ঐ বস্তু পেয়ে যাওয়ার কথা।
মেয়েরা আসন্ন দরদামের কথা ভেবে আনন্দে অধীর হয়ে গেল। এই কাজটি মেয়েরা কেন জানি না খুবই আগ্রহের সঙ্গে করে। চারঘন্টা সময় নষ্ট করে তারা একশ’ টাকার জিনিস ৯৫ টাকায় কিনে এমন ভাব করবে যেন তারা চেঙ্গিস খান, এইমাত্র এক রাজাকে যুদ্ধে পরাস্ত করেছে। চারঘন্টা তাদের কাছে কোনো বিষয় না, পাঁচ টাকা বিষয়।
আমি নিজে নিউ মার্কেট কাঁচা বাজারে এক অতি বিত্তবান তরুণীকে পেঁপের দাম দু’টাকা কমানোর জন্যে পঁয়তাল্লিশ মিনিট দরদাম করতে দেখেছি। বিত্তবান তরুণীরা পরিচয় দিলে আপনারা কেউ কেউ চিনতেও পারেন। তার নাম মেহের আফরোজ শাওন। তিনি ফিল্মে অভিনয় করেন এবং গান করেন।