০৫. শাওন ও লীলাবতী।
শাওনকে পরিচয় করিয়ে দেবার কিছু নেই। তার প্রভাতেই সে দীপ্ত। হুমায়ূন আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী পরিচয় অবশ্যই তার জন্যে সুখকর না। লীলাবতীর পরিচয় দেয়া প্রয়োজন। লীলাবতী তার গর্ভে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে থাকা কন্যা। গত পাঁচ মাস ধরে সে মায়ের পেটের অন্ধকারে বড় হচ্ছে। মা’র সঙ্গে সেও চীনে যাচ্ছে। তার ভ্রমণ অতি আনন্দময়। সে বাস করছে পৃথিবীর সবচে’ সুরক্ষিত ঘরে। সে ঘর অন্ধকার হলেও মায়ের ভালোবাসায় আলোকিত।
ভ্রমণ বিষয়ে শাওনের উৎসাহ সীমাহীন। যেখানে ঘরের বাইরে পা ফেলতে পারলেই সে খুশি, সেখানে সে যাচ্ছে চীনে! মিং ডায়ানেষ্টিক সভ্যতা দেখবে, চীনের প্রাচীর দেখবে।
দেশের ভেতর সে আমাকে নিয়ে ঘুরতে পারে না। প্রধান কারণ দোকানে দোকানে জিনিসপত্র দেখে বেড়ানো আমার স্বভাব না। রেস্টুরেন্টে রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া আমার অপছন্দ। তারপরে ও কোথাও কোথাও যাওয়া হয়। লোকজন তখন যে তার দিকে মায়া মায়া দৃষ্টিতে তাকায় তা-না। লোকজনের দৃষ্টিতে থাকে-হুমায়ূন আহমেদ নামক ভালো মানুষ লেখককে কুহক মায়ায় তুমি মুগ্ধ করেছ। তুমি কুহকিনী!
দেশের বাইরে তার সেই সমস্যা নেই। আমাকে পাশে নিয়ে কোনো রেস্টুরেন্টে খেতে বসলে কেউ সেই বিশেষ দৃষ্টিতে তাকাবে না। দু’একজন হয়তো ভাববে-বাচ্চা একটা মেয়ে বুড়োটার সঙ্গে বসে আছে কেন? এর বেশি কিছু না। এ ধরনের দৃষ্টিতে শাওনের কিছু যায় আসে না।
দেশের বাইরে শাওনের ঝলমলে আনন্দময় মুখ দেখতে আমার ভালো লাগে। তবে মাঝেমধ্যে একটা বিষয় চিন্তা করে বুকের মধ্যে ধাক্কার মতো লাগে। আমি ষাট বছরের বুড়ি ধরতে যাচ্ছি। চলে যাবরি ঘন্টা বেজে গেছে। আমার মৃত্যুর পরেও এই মেয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবে। সে কি একাকী নিঃসঙ্গ জীবন কাটাবে? না-কি আনন্দময় অন্য কোনো পুরুষ আসবে তার পাশে। সে কোনো এক রেস্টুরেন্টে মাথা দুলিয়ে হেসে হেসে গল্প করবে তার সঙ্গে-এই কী হয়েছে। শোন, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন না….’
০৬ পুত্র নুহাশ।
না না, সে আমাদের সঙ্গী না। শাওন যেখানে আছে সেখানে সে যাবে কিংবা তাকে যেতে দেয়া হবে তা হয় না।
নুহাশকে আমার সঙ্গে হঠাৎ হঠাৎ দেখা করতে দেয়া হয়। তবে আমার ঘরে ঢোকার অনুমতি দেয়া হয় না। সে আসে, গ্যারেজে দাঁড়িয়ে মোবাইলে এসএমএস করে জানায় বাবা আমি এসেছি। আমি নিচে নেমে যাই। গাড়িতে কিছুক্ষণ এলোমেলোভাবে ঘুরি। মাঝ মধ্যে মাথায় হাত রাখি। সে লজ্জা পায় বলেই চট করে হাত সরিয়ে নেই। তাকে বাসায় নামিয়ে মন খারাপ করে ফিরে আসি।
যে পুত্র সঙ্গে যাচ্ছে না তার নাম সফরসঙ্গী হিসেবে কেন লিখলাম? এই কাজটা লেখকরা পারেন। কল্পনায় অনেক সঙ্গী তারা সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে পারেন।
দীর্ঘ চীন ভ্রমণে অদৃশ্য মানব হয়ে আমার পুত্র আমার সঙ্গে ছিল। একবার ফরবিডেন সিটিতে প্রবল তুষারপাতের মধ্যে পড়লাম। কমল কমলের মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল, মাজহার তার ছেলেকে নিয়ে। আমি শাওনকে হাত ধরে ধরে নিয়ে যাচ্ছি। তার পেটে লীলাবতী। পা পিছলে পড়লে বিরাট সমস্যা। হঠাৎ দেখি একটু দূর দিয়ে মাথা নিচু করে নুহাশ হাঁটছে। তার মুখ বিষণ। চোখ আর্দ্র। আমি বললাম, বাবা, আমার হাত ধর। আমার দায়িত্ব শাওনকে হাত ধরে ঠিকমতো নিয়ে যাওয়া। তোমার দায়িত্ব আমাকে ঠিকমতো নিয়ে যাওয়া। সে এসে আমার হাত ধরল।
কল্পনার নুহাশ বলেই করল। লেখকরা তাদের কল্পনার চরিত্রদের নিয়ে অনেক কিছু করিয়ে নেন। লেখক হবার মজা এইখানেই।
প্রথম রজনী…
ঢাকা থেকে হংকং। হংকং থেকে বেইজিং।
প্লেন থেকে নামলাম। এয়ারপোর্টের টার্মিনাল থেকে বের হলাম, একসঙ্গে সবার মাথার চুল খাড়া হয়ে গেল। মেয়েদের চুল বলেই খাড়া হলো না, তবে ফুলে গেল। কারণ সহজ। তাপমাত্রা শূন্যের সাত ডিগ্রি নিচে। হাওয়া বইছে। টেম্পারেচারের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চিল ফ্যাক্টর। চিল ফ্যাক্টরের কারণে তাপমাত্রা শূন্যের আঠারো-উনিশ ডিগ্রি নিচের চলে যাবার কথা। এই হিসাব কেমন করে করা হয় আগে জানতাম। এখন ভুলে গেছি।
কমল বলল, হুমায়ূন ভাই, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব আছে।
আমি বললাম, হুঁ।
শুধু মেয়েরা খুশি। বেড়াতে বের হলে সব কিছুতেই তারা আনন্দ পায়। বড়ই আহ্লাদী হয়।
শাওন বলল, ঠাণ্ডাটা যা মজা লাগছে।
বাকিরাও তার সঙ্গে গলা মেলাল। তাদেরও নাকি মজা লাগছে। তারা সিগারেট খেলা শুরু করল। সিগারেট খাওয়ার ভঙ্গি করে ধোঁয়া ফেলে। সঙ্গে সঙ্গে নিঃশ্বাসের জলীয় বাষ্প জমে যায়। মনে হয়, বুনকা বুকা ধোঁয়া।
বাচ্চারা সবার আগে কাহিল হলো। কারোর হাত-মোজা নেই। ঠাণ্ডয় হাত শক্ত হয়ে গেল। তারা শুরু করল কান্না। কে তাকায় বাচ্চাদের দিকে বাচ্চাদের মায়েদের ঠাণ্ডা নিয়ে আহ্লাদী তখনো শেষ হয় নি।
বাংলাদেশ আম্বেসির ফাস্ট সেক্রেটারি অ্যাম্বেসির গাড়ি নিয়ে এসেছেন। তার নাম মনিরুল হক। তিনি আমাদের হয়ে হোটেল বুকিংও দিয়ে রেখেছেন। তাঁর দায়িত্ব আমাদেরকে হোটেল পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া। এক গাড়িতে হবে না। আরো কয়েকটা গাড়ি লাগবে। তিনি ব্যস্ত হয়ে চলে গেছেন গাড়ির সন্ধানে। আমরা দুর্দান্ত শীতে থরথর করে কাঁপছি।